Advertisement
E-Paper

খেলার জন্ম রেলাতে

এই পৃথিবীতে দুটো জিনিস তো রিয়েল দামি? রূপ আর গুণ। একটা থাকলেই লোকের কেতার আর অন্ত থাকে না। তা হলে দুটোই যার উপচে পড়ছে? আর সেই ঝমঝমানির দরুন ব্যাংকে এমন কাঁড়ি টাকা গজাচ্ছে যে গুনতে গেলে রামপালোয়ানেরও বাইসেপবেদনা?

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০০:০০

এই পৃথিবীতে দুটো জিনিস তো রিয়েল দামি? রূপ আর গুণ। একটা থাকলেই লোকের কেতার আর অন্ত থাকে না। তা হলে দুটোই যার উপচে পড়ছে? আর সেই ঝমঝমানির দরুন ব্যাংকে এমন কাঁড়ি টাকা গজাচ্ছে যে গুনতে গেলে রামপালোয়ানেরও বাইসেপবেদনা? তা হলে সেই দেবতার মতো সুন্দর আর জিনিয়াসের মতো গুণী আর কুবেরের মতো ধনী, মানে সেই অলীক অলৌকিক কম্বো-দুর্দান্তই কি ভগবানের সর্বফেভারিট সন্তান নয়? ফোর্বস বলছে, আমিই এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী খেলোয়াড়, সব খেলা মিলিয়ে। ইএসপিএন বলছে, আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত খেলোয়াড়। বয়স মাত্তর তিরিশ। এই সে দিন ব্যাক-হিল করে একটা গোল দিয়েছি, যা দেখে প্রত্যেকের আত্মা ট্যারা। এ যে হবে, আমি গোড়া থেকেই জানি। ছোটবেলায় এক জন টিচারকে চেয়ার ছুড়ে মেরেছিলাম, কারণ সে আমায় ‘অশ্রদ্ধা’ করেছিল! যদিও স্কুল থেকে আমায় বের করে দেওয়া হল, তাতে আমার ঘণ্টা! এই সে দিন একটা রিপোর্টারের হাত থেকে মাইকটা টেনে লেকের জলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। একটা ম্যাচের পর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেরিয়ে গেছি। অবাক হয়ে দেখছি, লোকে তেতো স্বরে বলছে, আমি উদ্ধত, রেলাবাজ। ই কী রে! আমি যদি রেলা না দেখাই, সেটাই তো অন্যায়! আমার যদি ইয়া সাইজের অহং নাগাড়ে ঝলক না দেয়, সেটাই তো মেগা-অবিচার!

সোজা কথা সোজা করে বলাই ভাল। মেসির প্রতি আমার হেভি ঈর্ষা। হবে না-ই বা কেন? আমি মনে করি আমি পৃথিবীর সেরা, ও মনে করে ও। খারাখারি স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে লোকে ফিসফাস করছে, মেসি কত ভাল স্বভাবের, আর এই লোকটাকে দেখো, সারা ক্ষণ কেচ্ছা আর ঝামেলাঝাঁটির সেন্টারে ড্রিব্‌লাচ্ছে, শুনে ধাঁ লাগে। মেসি যে ঝামেলা করে না, সে তো ওর গুণ নয়! দোষ। বিশ্বের সেরা হয়ে যে লাস্ট বেঞ্চের জ্যামিতি-ফেলের মতো মুন্ডু ঝুলিয়ে হাঁটে, তার তো নির্ঘাত জটজটিল প্রবলেম আছে। তুরন্ত মন-চিকিৎসক দেখানো দরকার। কে জানে, হয়তো ছোটবেলায় ওকে কেউ ধরে এমন পেটাত, ওর অন্তর-শিরদাঁড়াটা পটাং। তাই এত আয়ত্ত করেও ওর মধ্যে ধক গজাচ্ছে না। ও গরীয়ান অসাম্যের ফায়দাটা, নশ্বর মানুষদের হাটে ওর দৈব উচ্চতাটা উপলব্ধিই করতে পারছে না, উপভোগ করবে কী? হয় সারা ক্ষণ ভয়ে আছে, এই ম্যাজিক পা থেকে চলে গেল-গেল, বা বিষাদে আছে, দু’লাখ ডবকা যুবতী ওর ঘাড়ে ঝাঁপাচ্ছে না।

সেখানে অবশ্য কারও কিছু করার নেই। বাবা, ফুটবলে তুল্যমূল্য প্রচুর হবে, ও তিনটে গোল করল তো আমি চারটে, ও ফিফার খেতাব পাঁচ তো আমি তিন, ও ভলি তো আমি ব্যাকভলি। কিন্তু আসলি জায়গায় কোনও কম্পিটিশনই দাঁড়াবে না। আমি ফাটাফাটি দেখতে। তাই যৌবনের মূল কনফেটি আমার গায়ে ঝরবে ছপ্পর ফুঁড়ে। মেসি ‘রূপে ভোলাব না গোলে ভোলাব’ বলে আঁতলেমি মারতে পারে, কিন্তু আসলি দুনিয়ায় রিজার্ভ বেঞ্চে বসে ফোঁপাবে। বা ফোঁপানি লুকোবে, যেমন ওর মিনমিনিয়া।

মেয়েরা আমার ইশারায় হাঁউমাউ হিস্টিরিয়ায় নাচে। আমার গসিপ-গগনবিহারের সঙ্গে তুলনা হতে পারে শুধু ডন হুয়ান বা শ্রীকৃষ্ণের। এরা লীলার চোটে বিশ্বনিখিলকে চিড়বিড়ে হিংসেয় চুবিয়েছে, এখন আমি সে ব্যাটন নিয়ে জিগজ্যাগ মৃগলাবণ্যে ডজাচ্ছি। মেসির এ নিয়ে যমদুঃখু থাকতেই পারে। কারণ পেলে বা মারাদোনা তোমায় রেটিং-এ উঁচু নম্বর দিল, সে এক কথা, আর বডি-দলমল সুন্দরীর স্লিজি সমর্পণ জুটল আমার কপালে, সে হজম করা আর এক। অন্তর্বাসের মডেল হয়েই আমি কোটি টাকা রোজগার করতে পারি। উফ, আয়না যে নিত্যি ক্র্যাক করে যাচ্ছে না, সে-ই ভাগ্যি। মহান মিরাক্‌ল, এতটা গুণবানের আবার এতটা রূপওয়ালা হয়ে ওঠা। সেটা যে আমার ক্ষেত্রেই হয়েছে, আমিই যে আমি, তা ভেবে রোজ সকালে বিস্মিত হয়ে যাই।

মেসির প্রশংসা করে ফাটিয়ে দিয়ে লোকে বলে, মানুষটা কী ভাল! এই ভালমানুষ-জিনিয়াসের ধারণাটাই আমার মাথায় ঢোকে না! ভালমানুষি মানে কী? আমার যা ইচ্ছে করছে, সেটা না করে, চেপেচুপে রাখা। প্রকাশ্যে যেমন লোকে মলমূত্র চেপে রাখে। তা বাপ, মানুষের সংগ্রাম তো সমাজের মধ্যে এমন একটা জায়গা অর্জন করার সংগ্রাম, যেখানে তার ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনাটা বাড়বে। একটা কেরানি বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে। কেন? কারণ তা হলে তার ফাইভ-স্টার হোটেলে যাওয়ার ইচ্ছেটা সত্যি হবে। যুবক ফেশিয়াল করে অ্যাপো-য় যায়। কেন? তার প্রেমের আকাঙ্ক্ষাটা সত্যি হওয়ার দিকে হেলবে। তা, আমার তালুতে গুপ্তধন-ভর্তি সিন্দুকের চাবিটা অলরেডি সড়সড় করছে, আর আমি সিন্দুক খুলছি না, এ কি নর্মাল? না কি আমি মর্ষকামী, আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে গূঢ় আনন্দ পাচ্ছি? না কি এমনই প্রথা-গাধা, লোকে আনন্দকে ভয় পায় বলে আমিও তাই শিখে নিয়েছি?

আমার কথা হল, বাপ, শ্রেষ্ঠ মস্তানের নজরানা পাচ্ছ, লুটে নাও। ফাঁকা গোল পাচ্ছ, বল ঠেলে দাও। ভালমানুষ হয় তারা, যারা খারাপ মানুষ হওয়া অ্যাফোর্ড করতে পারে না। তাইলে তারা কোঁতকা খাবে। পুলিশে ধরবে, বউ ছেড়ে চলে যাবে, প্রতিবেশী ইট ছুড়বে। ভালমানুষি হচ্ছে ভীরুমানুষি। সক্কলের অনেকের সঙ্গে শুতে ইচ্ছে করে, যে শোয় না সে হয় এড্সকে নয় স্ক্যান্ডালকে ভয় পায়। সক্কলের ইচ্ছে করে নাক-গলানো রিপোর্টারগুলোর নাক মুচড়ে মাইক ছুড়ে ফেলে দিতে, যে দেয় না, সে ভয় পায়, মিডিয়া তাকে বয়কট করবে। এ সব আমার ক্ষেত্রে খাটবে কেন? আমি হব আকাশছোঁয়া বিশাল, আর চলব-ফিরব যেন হরিদাস পাল? এ সব ন্যাতনেতে মূল্যবোধগুলোকে যে ব্যাক-হিল করতে পারে না, সে প্লেয়ার?

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy