ভাষার উপর আঘাত হানা শাসকের চিরায়ত কৌশল
পুলওয়ামার জঙ্গি হানায় ৪৯ জন জওয়ান নিহত হয়েছেন। তার পরেই দেশের অন্য রাজ্যের মতো শান্তির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়েছে অশান্তি। বিক্ষিপ্ত, তবু তার কুপ্রভাব অনস্বীকার্য। পুলওয়ামার জওয়ান বনাম জঙ্গি দ্বৈরথটা এখন কম-বেশি একটি রাজনৈতিক দল ও বিশেষ ধর্মের মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু হামলাকারী জঙ্গি জইশ-ই-মহম্মদ নেতার ধর্ম ইসলাম, তাই সব মুসলিম এই হামলার জন্য দায়ী, এমন পরিকল্পিত সাধারণীকরণ করা হচ্ছে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তও অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। বলা ভাল, জঙ্গি হামলার পরে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ সরকারের সমালোচনা, নিরাপত্তার গলদ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করলেই নেমে আসছে আক্রমণ— আলোচনাকারীর ধর্ম যাই হোক না কেন। সরকার মানে কিন্তু রাষ্ট্র নয়, নয় দেশ। বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল, যার প্রচারিত ‘নকল জাতীয়তাবাদে’র বিরোধিতা করলেই নেমে আসছে বিপদ। হাবড়ার এক কিশোর কিছু প্রশ্ন তুলেছিল। সে বলেছিল, সৈন্যদের মৃত্যু শোকের। পাশাপাশি, কাশ্মীরি যুবকদের মৃত্যুর নিন্দা করুন। উগ্র জাতীয়তাবাদের ঠিকাদারেরা তার বাড়িতে হামলা করে, তাকে নিগ্রহ করে; শোনা যাচ্ছে, কিশোরের বাবা-মাকেও মানসিক ভাবে অপদস্থ করা হয়। অবশেষে, নিগৃহীত অর্পণকেই পুলিশ গ্রেফতার করে। না, গেরুয়াবাহিনীর দাপটে কেউই স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারবে না। করলে তারা হামলা চালাবে, মিথ্যে কেস দেবে, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে নিগৃহীতকেই।
চিত্রদীপ সোম। উত্তর কলকাতার এক নামী বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। বাড়ি বনগাঁয়। চিত্রদীপ একটি টেকনিক্যাল প্রশ্ন তুলেছিলেন। পুলওয়ামার জঙ্গি হানায় নিহত জওয়ানরা ‘শহিদ’ কিনা! তিনি বলেছিলেন যে, একটি আরটিআইয়ে জানা গিয়েছিল, ওই নিহত জওয়ানদের ঠিক ‘শহিদ’ না বলে কর্তৃপক্ষ ‘ব্যাটল ক্যাজুয়ালিটিজ’ বলে থাকেন। আর তাতেই আক্রমণ। প্রথমে চিত্রদীপের বাড়িতে আক্রমণ ও ভাঙচুর করা হয়। তাঁকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়ানো হয়। চিত্রদীপ কলকাতায় চলে এলেও রেহাই মেলে না। তাঁর বাড়িতে পুনরায় হামলা হয়। এমনকি, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে।
দুর্গাপুরের কৃষ্ণেন্দু সেনগুপ্তও অনুরূপ হামলার শিকার। তাঁকেও তাঁর কাজ থেকে বরখাস্ত করেছে লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানি।
তিনটি ঘটনায় গোটা তিনেক ব্যাপার এক রকমের— প্রথম হল, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া। দ্বিতীয়, ভিন্ন মতপোষণকারীদের নিগ্রহ করা ও নিগ্রহকারীর মতকে জোর করে নিগৃহীতের উপর আরোপ করা এবং তৃতীয়টি হল, তিন ভিক্টিমকেই শাস্তি দেওয়া। ভিন্ন মতকে টুঁটি টিপে মারার এই যে নানা রকমের পরিকল্পিত স্তর, সেটাই ভয়ের।
অথচ, যখন শাসকদলের এক জন সাংসদ বলেন, সিআরপি জওয়ানেরা তো মরবেই কারণ তাঁরা মরার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন কিংবা অন্য নেতারা বলেন, ৪৪ কেন ৪৪৪ জন জওয়ান মরলেও কোনও ক্ষতি নেই— এই মৃত্যুতে ভর করে তাঁরা ক্ষমতায় আসবেন; তখন কিন্তু ‘জাতীয়তাবাদ’ বা সেনা-প্রেমের কথা আর ওঠে না। এই মুহূর্তে এ দেশের ‘জাতীয়তাবাদ’ হল, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একমত হওয়া। তাতে দেশ-বিরোধিতারও ক্ষমা আছে। কেউ এমন প্রশ্ন করতে পারবেন না যাতে দল বিপদে পড়ে বা দলের কোনও সমস্যা হয় ক্ষমতায় আসতে। সীমান্তে যুদ্ধ করছেন কিংবা পাহারা দিচ্ছেন যে জওয়ানেরা, তাঁরা যেমন দেশের সম্পদ; তেমনি এই দেশের ভিতর যাঁরা দেশকে অন্য পরিষেবা দিচ্ছেন তাঁরাও দেশের সম্পদ। যে শিক্ষক পড়ুয়াদের তর্ক করতে শেখাচ্ছেন, বলছেন বিরোধী মতকে শ্রদ্ধা করে তাকে খণ্ডন করতে, সেই শিক্ষকও দেশের সম্পদ। আচার্য শঙ্করের মায়াবাদের বিরুদ্ধে সপ্তধা অনুপপত্তি তুলেছিলেন আচার্য রামানুজ। দুই আচার্য আমাদের শ্রদ্ধার। কিন্তু সেখানে এমন শারীরিক নিগ্রহের প্রশ্ন ওঠেনি।
মনে রাখতে হবে, এই দেশ সেই প্রতর্কের পুণ্যভূমি যেখানে তর্ক করাটা একটা ঐতিহ্য। প্রতর্কের পরিসর ছেড়ে দৈহিক আক্রমণ করে যারা, তারাই এই দেশের শত্রু। বেদ, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, মহাকাব্য— সবেতেই এমন বিতর্কের নিদর্শন ভুরি ভুরি।
কাশ্মীরি শৈব দর্শনেও এমন তর্কের পরিসর অনেকখানি। কাশ্মীর শৈবচিন্তার পুরোধা বসুগুপ্ত, উৎপল, ক্ষেমরাজ, আনন্দবর্ধন, অভিনবগুপ্তরা কাশ্মীরের মানুষ। দার্শনিক অভিনবগুপ্ত অদ্বৈত তান্ত্রিক মতকে বলেছিলেন ‘ত্রিক’— শিব ও শক্তি দিয়ে তিনি এই জগতের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পাণিনির ব্যাকরণের মহাভাষ্য রচয়িতা পতঞ্জলি কাশ্মীরের ভূমিপুত্র ছিলেন, যিনি চরকের আয়ুর্বেদ পুনর্লিখন করেন। সংস্কৃত ভাষায় আয়ুর্বেদ সাহিত্য বা দার্শনিক সাহিত্যচর্চাই শুধু নয়, উপত্যকার প্রখ্যাত মানুষ শীতিকান্ত ত্রয়োদশ শতকে কাশ্মীরি ভাষায় রচনা করেন মহানায়কপ্রকাশ। সুফি কবি শামস ফকির থেকে জিন্দা কাউল কাশ্মীরি ভাষায় রচনা করে গিয়েছেন রহস্য কাব্য। অশান্ত উপত্যকায় এখন ফারসি বা সংস্কৃত ভাষায় নিশ্চয় লেখালেখি হয় না। উপত্যকায় হিন্দি-উর্দু ভাষায় এখন বহু মানুষ লেখালেখি করেন। তবে অমরনাথ কাক কিংবা অগ্নিশেখরের উত্তরসূরিরা এখনও রয়েছেন কাশ্মীরে।
কেন ভাষার কথা লিখছি? গত পাঁচশো বছর বা তার বেশি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরের শাসক বদলেছে বার বার। শাসক চিরকাল শাসিতদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। তাকে বাগে আনার জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করে থাকে। একটি চিরায়ত কৌশল হল শাসিতের ভাষার উপর আঘাত হানা। ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে সেই জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাস। আগ্রাসন আর ক্ষমতায়নের দৃশ্য-অদৃশ্য শিকলে কাশ্মীরি ভাষা তথা জনগণকে বাঁধা হয়েছে। সেই শেকল কাটার চেষ্টা তাঁরা করেছেন বার বার। শাসক চিরকাল চেয়েছে, শাসিত কাশ্মীরিদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিতে। আর তা কেড়ে নেওয়ার অন্যতম পদক্ষেপ করা হয়েছিল তাঁদের মাতৃভাষার উপর আঘাত হানা। আজ তাই উপত্যকায় কাশ্মীরি ভাষার চর্চা তেমন নেই, যতটা আছে উর্দু বা হিন্দির প্রচলন।
দেড় হাজার বছর পিছনে হাঁটলে দেখা যাবে, কাশ্মীর ধর্মের দিক থেকে প্রথমে হিন্দু ও পরে বৌদ্ধ ধর্মের একটি কেন্দ্র ছিল। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে এখানে শৈব দর্শনের বিকাশ ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইসলাম প্রবেশ করে। ইসলাম কাশ্মীরে এসে তার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে কাশ্মীরি সুফিবাদের জন্ম দেয়।
বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের দর্শনের বিভাগীয় প্রধান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy