Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অধিকারের সীমা

বিচারপতি আর এফ নরিম্যান এবং ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় মনে করিয়াছেন যে অন্য ধর্মের আচার কিংবা অন্য কোনও মামলা যে হেতু এই মূহূর্তে বিচারাধীন নহে, কেবল শবরীমালা মন্দিরের প্রশ্নটিই বিচারাধীন— তাহার রায়কে এত বড় পরিসরে দেখিবার চেষ্টা অনাবশ্যক ও অর্থহীন।

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:১১
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি-সংবলিত সংবিধান বেঞ্চ হইতে শবরীমালা রায়ের পুনর্বিবেচনার ভার তাহা হইলে গিয়া পড়িল সাত সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে। ওই পরবর্তী বেঞ্চ আবার নূতন করিয়া শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মহিলাদের প্রবেশের অধিকার বিচার করিবে। ধর্মীয় সংস্কার ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত যুক্তিমালা পুনর্বার খুঁটাইয়া দেখিবে। এমনকি অন্য ধর্মের আচার ও সংস্কারের ক্ষেত্রে এই মামলার প্রভাব পড়িবে কি না, পড়িলে কেন পড়িবে, ইত্যাদিও বিচার করিবে। সমস্যা হইল, শবরীমালার মামলাটির পরিসর বাড়াইয়া ধর্ম বিষয়ক এমন একটি সাধারণ অবস্থান এই মামলার সূত্রে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত কি না— এই বিষয়টি লইয়া বিচারপতিরা নিজেরাই গভীর দ্বন্দ্বে দীর্ণ। ৩-২ ভাগে তাঁহারা বিভক্ত হইয়া গিয়াছেন এই প্রশ্নে। বিচারপতি আর এফ নরিম্যান এবং ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় মনে করিয়াছেন যে অন্য ধর্মের আচার কিংবা অন্য কোনও মামলা যে হেতু এই মূহূর্তে বিচারাধীন নহে, কেবল শবরীমালা মন্দিরের প্রশ্নটিই বিচারাধীন— তাহার রায়কে এত বড় পরিসরে দেখিবার চেষ্টা অনাবশ্যক ও অর্থহীন। যে প্রশ্ন ‘উঠে নাই কিন্তু উঠিতে পারে’, আগে হইতে সাত তাড়াতাড়ি তাহা ভাবিয়া বিচার করিতে বসা বিচারের উপযুক্ত পদ্ধতি হইতে পারে না। তৎপরিবর্তে কেবল শবরীমালার উপরেই মনোযোগ নিবদ্ধ করা উচিত— কেননা তখন অধিকার-অনধিকারের প্রশ্নের মধ্যে এক রকমের বৈষম্য স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়িতে পারে, এবং সেই বৈষম্য অসাংবিধানিক বলিয়া প্রতিভাত হইতে পারে। প্রসঙ্গত, গত বৎসরের রায়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় শবরীমালা মন্দিরের এই বৈষম্যকে বর্ণবৈষম্যের সহিত তুলনীয় বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। বাস্তবিক, এই বারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুই বিচারপতির ‘সংখ্যালঘু মত’টির গুরুত্ব অনেক। গুরুতর কতকগুলি কথা তাঁহাদের যুক্তিধারায় উঠিয়া আসিয়াছে। সংখ্যাগুরু মতের চাপে সেগুলি উড়াইয়া দেওয়া একান্ত অনুচিত কাজ হইবে।

উঠিয়া আসিয়াছে আরও একটি বিষয়: ধর্মের ক্ষেত্রে কাহাকে বলা যাইতে পারে অবশ্যপ্রয়োজনীয় প্রথা, কাহাকে নয়। মন্দিরে ঋতুমতী মহিলাদের প্রবেশ বন্ধ করা কত দূর অবশ্যপ্রয়োজনীয় প্রথা বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে, ইত্যাদি। প্রশ্নটি জরুরি, কেননা ইহার উপর নির্ভর করিতেছে চূড়ান্ত রায়ের অভিমুখ। যদি কোনও আচার ‘এসেনশিয়াল প্র্যাকটিস’ পরীক্ষায় পাশ না করে, তাহা হইলে বৈষম্যের মূল্যে তাহাকে রাখিবার প্রশ্নটিও অনেকাংশে দুর্বল হইয়া যায়। আবার সত্যই যদি কোনও অবশ্যপালনীয় প্রথা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, প্রথার পক্ষে যুক্তিগুলিও জোরদার হইতে পারে। মুশকিল হইল, এমন পরিস্থিতিতে, অবশ্যপালনীয়তার বিবেচনাটি আদালতের ঘাড়ে আসিয়া পড়িলে। ধর্মে কোনটি আবশ্যক, কোনটি নহে, তাহার বিচার করা ধর্মতত্ত্বের কাজ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার কাজ তো নহে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই দায়িত্বের ঝুলি লইয়া বসিতে পারে না। এই কাজ মাননীয় বিচারপতিদের নহে, এই দায়িত্ব তাঁহাদের উপর চাপানো তাঁহাদের প্রতিই অবিচার। তদুপরি, এই প্রশ্নে একাধিক ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনা বিভিন্ন প্রকারের হইয়াছে, তাহাও স্পষ্ট।

এই কারণেই, বাবরি মসজিদের মুসলিমদের নিয়মিত নমাজ না পড়িবার প্রথাটিকে মসজিদের অধিকারের বিপক্ষ যুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা যেমন নীতিগত ভাবে সমস্যাজনক, শবরীমালায় ঋতুমতী মহিলাদের প্রবেশাধিকার বন্ধের যুক্তিটিও তাই। বিচারবিভাগের অনেক দায়িত্ব। কিন্তু যে দায় বা দায়িত্ব তাঁহাদের স্বাভাবিক ভাবেই নাই, তাহা হইতে দূরত্ব রক্ষা করাও একটি গুরুতর কর্তব্য। ভবিষ্যতে শবরীমালা রায় যে দিকেই যাক না কেন, ভারতে ধর্মাচারের ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের অধিকারের সীমা কত দূর, তাহা অনেকাংশে ইহার দ্বারা নির্ধারিত হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sabarimala Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE