Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সৌদির মেয়েরা, এবং আমরা

সৌদিতে মেয়েরা গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা পেয়েছে তো আমাদের কী? আমাদের তো আর সে সমস্যা নেই। আমাদের এখানে তো কত মহিলা গাড়ি চালাচ্ছে, কোনও অসুবিধা তো নেই।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে তখন ব্যস্ত আমরা। কলকাতা থেকে ৩৪৯৬ কিলোমিটার দূরে, তৃতীয় বিশ্বেরই আর একটি দেশে তৈরি হল ইতিহাস। এমন ইতিহাস, যার জন্য সেই ইতিহাসস্রষ্টাকে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত করার কথা হচ্ছে। ২৭ তারিখ, বাংলার ১০ আশ্বিন ২৭ বছর লড়াই করার পরে সৌদি আরবে স্বীকৃত হল মহিলাদের নিজস্ব ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার অধিকার। ইতিহাস সৃষ্টি হল। ইতিহাস, বা ইতিহাসের সূচনা। সৌদি আরবে কড়া শরিয়তি আইনে মহিলাদের পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কোনও কাজেরই স্বাধীনতা নেই। মহিলাদের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে, কেনাকাটা করতে গেলে, কোথাও যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে গেলে, এমনকী প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের জন্যও পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে নিজস্ব ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া মানে প্রকারান্তরে তার নিজের চলাফেরার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া। মানাল আল-শারিফ এবং ওয়াজেহা আল-হুয়াইদার যখন শুরু করেছিলেন এই আন্দোলন, তখন তাঁদের জেলবন্দি করা থেকে শুরু করে পাসপোর্ট পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। মানাল আল-শারিফকে নির্বাসিত করা হয়েছিল তাঁর নিজের দেশ থেকে, এবং নিজের পুত্রের সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করতেও বাধা দিয়েছিল সৌদি আরবের ধর্মীয় বাহিনী। তাই তাঁর অবদানকে যুগান্তকারী বলতে দ্বিধা নেই। সেই কারণেই তাঁর নোবেল মনোনয়নেরও প্রসঙ্গ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সৌদিতে মেয়েরা গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা পেয়েছে তো আমাদের কী? আমাদের তো আর সে সমস্যা নেই। আমাদের এখানে তো কত মহিলা গাড়ি চালাচ্ছে, কোনও অসুবিধা তো নেই। সত্যিই কি তা-ই? তা হলে এখনও এ দেশে গাড়িচালকদের শতকরা আশি শতাংশ পুরুষ কেন? সারা বিশ্বের পরিসংখ্যানে যেখানে পুরুষ চালকদের থেকে মহিলা চালকদের হার ১৫% বেশি? এখনও রাস্তায় মহিলা গাড়িচালক দেখলে ড্রাইভারের সিটে বসা পুরুষটি ব্যঙ্গের হাসি এবং মন্তব্য ছোড়েন কেন? “এই রে মেয়েছেলে গাড়ি চালাচ্ছে, গেল আমার গাড়িটা!”— এক পরিচিত বাক্যবন্ধ। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের ছায়া গাড়ি চালানো বা না চালানোর উপরও পড়বে, লিঙ্গপার্থক্যের ঔপনিবেশিক কদর্যরূপ সেখানেও দেখা যাবে, এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। আইনত নারী ও পুরুষের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভেদাভেদের কোনও ইতিহাস ভারতে নেই। কিন্তু আর পাঁচটা ব্যাপারের মতোই এ ক্ষেত্রেও আইন আর বাস্তবের মধ্যে কয়েক যোজন দূরত্ব।

সৌদি আরবের মহিলাদের জন্য যে সব বাধানিষেধ উচ্চারিত এবং তাঁদের যে সব স্বাধীন আচরণ আইনত দণ্ডনীয়, তা আমাদের কাছে কখনও অনুচ্চারিত (কিছু ক্ষেত্রে উচ্চারিতও বটে) এবং সামাজিক ভাবে (বা স্বতঃপ্রণোদিত সালিশি আইনের চোখেও) দণ্ডনীয়। তাই যে অধিকার তাঁরা লড়াই করে অর্জন করেছেন, সেই লড়াই আমাদেরও করণীয়। সৌদি আরবের মেয়েদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ইতিহাস আমাদের কাছেও সমান প্রাসঙ্গিক। আশার কথা, ২০০০ সালের পর থেকে তথ্যরা কিছু আশাব্যঞ্জক ছবি দেখাচ্ছে। মহিলা চালকদের সংখ্যা প্রতি বছরই ১.৩% বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহিলা চালিত ট্যাক্সি, অটো, মিনিবাসের খবর মাঝে মাঝেই কাগজে ফুটে ওঠে। দিল্লির প্রথম মহিলা বাসচালক বি সরিথা বা প্রথম মহিলা ট্রাকচালক যোগিতা রঘুবংশী-র কথা আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু তাঁরা আজও শুধু খবরের শিরোনাম হয়ে আছেন।

প্রতিযুক্তি হিসেবে মহিলাদের নৌবাহিনীতে অংশগ্রহণ বা যুদ্ধবিমান চালানোর কথা বলতে পারেন কেউ। কিন্তু দুটি বিষয়কে এক বন্ধনীতে ফেলা সম্ভবত ঠিক হবে না। নৌবাহিনীতে যোগদান করছেন যে মহিলা আর ছেলেকে স্কুল থেকে আনার জন্য দু’চাকা বা চার চাকার বাহনে অসামরিক পরিসরে চালকের আসনে বসার স্বাধীনতা চাইছেন যে মহিলা, তাঁদের পরিসর ভিন্ন। কার সংগ্রাম, কার অধিকার, কার দক্ষতা কম বা বেশি, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। মূল কথা, লড়াইটা ভিন্ন। যিনি গাড়ি চালিয়ে অসুস্থ বাবা বা শ্বশুরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, ছেলেকে স্কুল থেকে এনেই কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর দক্ষতাকে ছোট করে দেখার বা একেবারেই না দেখার জন্য সমাজ প্রস্তুত। ওই গাড়ি চালানোর মাধ্যমে পরিবার নামক ইউনিট যেটুকু পরিষেবা পাচ্ছে, তার জন্যই তার এই গাড়ি চালানোর অভ্যেসকে কোনও মতে মেনে নেয়।

আর যদি সেই মা বা পুত্রবধূ, নিজের বা পরিবারের প্রয়োজনে নয়, শুধু নিজের ইচ্ছেতে গাড়ি চালিয়ে বেরোতে চায়? যদি বলে ‘যাই আড্ডা মেরে আসি’ বা ‘সিগারেটটা কিনে নিয়ে আসি’? তখন সেই গাড়ি চালাতে পারাই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না তো?

তাই ড্রাইভিং লাইসেন্সের আইনি অধিকার প্রয়োজন, সেই আইনের প্রয়োগের পথ খোলাও প্রয়োজন। আর সব থেকে প্রয়োজনীয় হল মহিলাদের ইচ্ছের লাইসেন্সে স্বপ্নের স্বাধীনতা। সৌদির মহিলাদের মতোই আমাদের লক্ষ্যও তো একই শিকল ভাঙার উড়ান। মানাল আল-শরিফের ইতিহাস তাই আমাদের সকলেরই ইতিহাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Saudi girls Freedom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE