Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
আবেগ বনাম বাস্তব
Somen Mitra

কোনও বড় নেতার দলবিরোধী কাজও কি প্রশংসার যোগ্য

সোমেনবাবুর মতো বিশিষ্ট রাজনীতিকের বিবিধ কার্যকলাপ ফিরে দেখাও তাই দরকার। যেখানে ব্যক্তি সোমেনদা নন, আলোচ্য কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র।

রাজনৈতিক: এসপ্ল্যানেড ইস্ট-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কংগ্রেসের সমাবেশ-মঞ্চে উপস্থিত সোমেন মিত্র। ১৯ মে, ১৯৯২।

রাজনৈতিক: এসপ্ল্যানেড ইস্ট-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কংগ্রেসের সমাবেশ-মঞ্চে উপস্থিত সোমেন মিত্র। ১৯ মে, ১৯৯২।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

মৃত্যু মানুষকে সাধারণত মহান করে দেয়। বিশেষ করে যাঁরা মান্যগণ্য, সুপরিচিত, তাঁদের ক্ষেত্রে এটা বেশি প্রযোজ্য। অন্তত আমাদের এখানে। কিন্তু অর্ধসত্য অথবা খণ্ডসত্য ইতিহাসের শত্রু। ভাল-মন্দের মিশেলে এক জন ব্যক্তির ভাবমূর্তি নির্মিত হয়। গেলাসের জল কতখানি ভর্তি, বা কতখানি খালি, সেটা নিয়ে ভিন্নমত থাকা খুবই স্বাভাবিক। তা বলে, গেলাসটি যে পুরো ভর্তি নয়, সেই সাদামাটা সত্যটুকু না-মানাও কোনও উচিত কাজ হতে পারে না।

কথাগুলি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের প্রয়াণের পরিপ্রেক্ষিতে। অর্ধ শতকেরও বেশি সময় জুড়ে বাংলার কংগ্রেস রাজনীতিতে যুক্ত থেকে, সাংগঠনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থান ও প্রতিষ্ঠা মজবুত করে তুলেছিলেন তিনি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা অর্জন করার মতো অনেক গুণ তাঁর নিশ্চয় ছিল।

বয়ঃবৃদ্ধ সোমেনবাবুর হাতে মাত্র দু’বছর আগে আরও এক বার প্রদেশ কংগ্রেসের ভার তুলে দেওয়া, এক অর্থে, হয়তো কিছুটা চমকপ্রদ মনে হতে পারে। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসে সেই সময়ের তরুণ সভাপতি রাহুল গাঁধীর ওই সিদ্ধান্ত সোমেনবাবুর যোগ্যতার প্রতি এক স্বীকৃতি, যা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সোমেন মিত্রকে একটি বড় মর্যাদায় চিহ্নিত করে রাখল।

আরও পড়ুন: কেমন হবে পদবি-মুক্ত জীবন

আরও পড়ুন: এই বিরাট অধর্ম সইবে তো

রাজ্যের কংগ্রেস রাজনীতিতে গোষ্ঠীবাজির ধারাবাহিকতায় সোমেন মিত্র চির দিনই ছিলেন এক উজ্জ্বল নাম। আসলে ভাল সংগঠক না হলে গোষ্ঠীনেতা হওয়া শক্ত। তাঁর সেই সাংগঠনিক মুনশিয়ানার কিছু সুফল সোমেনদা অবশ্যই নানা ভাবে পেয়েছেন। সদ্যপ্রয়াত এই নেতার প্রতি আজও তাঁর সমর্থক, অনুরাগীদের ভাবাবেগ থেকে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়।

তবে সেই শ্রদ্ধা-ভক্তি-অনুরাগ প্রকাশ করতে গিয়ে কতিপয় আধা-সিকি মাপের লোক যে কায়দায় বটতলার ওকালতি শুরু করেছেন, তাতে কিছু তথ্যের বিকৃতি ঘটছে বলে ধরে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সোমেনবাবুর মতো বিশিষ্ট রাজনীতিকের বিবিধ কার্যকলাপ ফিরে দেখাও তাই দরকার। যেখানে ব্যক্তি সোমেনদা নন, আলোচ্য কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র।

ইন্দিরা-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করা যেতে পারে। ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে মমতার কাছে যাদবপুর থেকে হেরে সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বোলপুর উপনির্বাচনে লড়তে যান। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। রিপোর্টার হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম, কংগ্রেসের একটি অংশ সিদ্ধার্থবাবুকে হারাতে কেমন কোমর বেঁধেছে! তাঁদেরই এক জন সোমেনবাবু।

তাঁকে বলা হয়েছিল, সিপিএমের সেই সময়ের ‘দুর্ভেদ্য’ ঘাঁটি মঙ্গলকোট ও আউশগ্রামে (জঙ্গলমহল) ভোট সংগঠিত করতে। আগের সন্ধ্যায় গুসকরায় অশোক সেনের ঘনিষ্ঠ এক বর্ষীয়ান কংগ্রেস কর্মীর সাবেক আমলের বাড়িতে পৌঁছে সোমেনবাবু দেখলেন, কলকাতা থেকে ‘পাঠানো’ ছেলের দল হাজির। খাওয়ার আয়োজন চলছে। তিনি কপট ক্রোধে চেঁচিয়ে উঠলেন, “তোরা পিকনিক করতে এসেছিস? এখানে কেন? এখনই সবাই সোজা জঙ্গলমহলে চলে যা। ওখানে সিপিএমের তির সামলা গিয়ে!” ছেলের দল ভয়ে সিঁটিয়ে বলতে লাগল, “ছেড়ে দাও ছোড়দা। আমরা কিছু খাব না। কোথাও যাব না। কলকাতায় চলে যাচ্ছি।”

এখানেই শেষ নয়। দুর্গাপুরে রাত কাটিয়ে পর দিন দুপুরের মধ্যে সোমেনবাবুও কলকাতার পথ ধরেছিলেন। সিদ্ধার্থশঙ্করের কাছে সেই খবর যখন পৌঁছয়, তখন কংগ্রেসের কার্যত এজেন্টবিহীন বুথগুলিতে ভোট শেষ! সোমেনবাবু থাকলেও যে সিদ্ধার্থবাবু জিততেন, তা একেবারেই নয়। কিন্তু কংগ্রেসের বরিষ্ঠ রাজ্যনেতা হয়ে সোমেনবাবু যে ভাবে নিজের দলের প্রার্থীকে পথে বসিয়েছিলেন, সেটা তো মিথ্যে নয়।

১৯৯২-এর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর জন্য সোমেনবাবুর প্রয়াসে হয়তো ভুল নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে একে অপরকে হারাতে চাইবেনই। তবু নদিয়ার ভোটার তালিকা নিয়ে সমস্যা কেন হয়েছিল, মহারাষ্ট্র নিবাস হল-এ গণনার সময় কারা কাদের উপর চড়াও হল, চেয়ার ছোড়াছুড়ি, মাথা ফাটা, হাত ভাঙার পিছনে উস্কানি ছিল কাদের, সেই সব প্রশ্ন ফুরিয়ে যেতে পারে না।

প্রসঙ্গত, ওই বছরেই নভেম্বরে যুব কংগ্রেসের নামে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মমতা ব্রিগেডে সমাবেশ ডাকেন। প্রথমে ইতস্তত করেও সোমেন মিত্র অবশেষে তাতে যোগ দেন এবং অকপটে বলেন, এই জনসমাগম দেখে মমতাকে ঈর্ষা করতে হচ্ছে।

এ বার মমতার কংগ্রেস ত্যাগের কাহিনি। ১৯৯৭-এর ৮ থেকে ১১ অগস্ট নেতাজি ইন্ডোরে হল এআইসিসি-র বিশেষ অধিবেশন। সীতারাম কেশরী তখন সর্বভারতীয় সভাপতি। সনিয়া গাঁধী নেপথ্যে থাকা ‘বিবেক’। মঞ্চে তাঁরা দু’জনেই হাজির। সোমেনবাবু প্রদেশ সভাপতি।

মমতার অভিযোগ ছিল, সিপিএমের কাছে দল বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ৯ অগস্ট মেয়ো রোডে গাঁধী মূর্তির নীচে তিনি পাল্টা সমাবেশ করে ভিড় জমিয়ে দিলেন। ইন্ডোর প্রায় উজাড়। মমতা বললেন, “ওরা ছিন্নমূল। আমরা তৃণমূল। এটাই আসল কংগ্রেস।” কংগ্রেসের পতাকার তলায় সিপিএম-বিরোধী ওই পাল্টা জনসমাগম যে সোমেনবাবুদের রাজনৈতিক ‘বিশ্বস্ততার’ প্রতি ইতিবাচক ইঙ্গিত ছিল না, বলাই বাহুল্য। হাল বুঝে ইন্ডোর থেকে এক প্রতিনিধিকেও পাঠানো হয়েছিল সেখানে।

তখনই ফাটল শুরু হলেও কাগজকলমে আসলে কংগ্রেস ভাঙল নভেম্বরে। আর সেটি ত্বরান্বিত হল একটি তাৎক্ষণিক ঘটনার জেরে। মমতা যাতে ১৯৯৮-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রদেশ নির্বাচন কমিটির মাথায় বসে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াতে ঢুকতে না পারেন, সোমেনবাবুরা সেই চেষ্টায় আগে থেকেই তৎপর ছিলেন। তাঁরা চাইছিলেন মমতাকে প্রচার কমিটিতে ঠেলে দিতে। কেশরীকে তাঁরা সঙ্গে পান। মধ্যস্থতায় নেমে সনিয়া উভয় পক্ষকে তিন-চার দিন নীরব থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু সেই আহ্বান কার্যত উপেক্ষা করে সীতারাম কেশরী হঠাৎ হায়দরাবাদ থেকে জানিয়ে দেন, মমতা প্রচার কমিটিরই প্রধান হবেন, নির্বাচন কমিটির নয়।

খবরটি সঙ্গে নিয়ে মমতার কালীঘাটের বাড়ি গিয়ে দেখি, ভিতরে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করছেন রঞ্জিত পাঁজা ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাইরে অতীন ঘোষ। সংবাদ শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মমতা। সেখানেই সিদ্ধান্ত নিলেন, পর দিন বিকেলে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ঘোষণা করবেনই। সেই মতোই কাজ হয় এবং কংগ্রেস তৎক্ষণাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করে।

অনেকে বলেন, সোমেনবাবুকে মমতার বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করতে ‘বাধ্য’ করা হয়েছিল। তবে পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে সনিয়াকে এড়িয়ে কেশরীর ওই ঘোষণাটির পিছনে সোমেনবাবুর ভূমিকা ছিল না, এটা কিন্তু যুক্তিতে মেলে না। তা ছাড়া, কংগ্রেসের মূল স্রোত মমতার সঙ্গে চলে যাওয়ায় এটাও বোঝা যায়, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেস সমর্থকদের আস্থা হারিয়েছিল। এটা না হলে রাজনীতি কোন খাতে বইত, কে বলতে পারে!

২০০০-এর রাজ্যসভা ভোটে নিজের দল কংগ্রেসের প্রার্থীকে হারাতে আবার মমতার কাছেই ছুটেছিলেন সোমেনবাবু। কারণ এআইসিসি-র মনোনীত দেবপ্রসাদ রায়কে তিনি হারাতে চেয়েছিলেন।

তাই এক দিন বেশি রাতে গোপনে মমতার সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। বৈঠকটি হয় ল্যান্সডাউন মার্কেটের পাশের রাস্তায় মমতার তৎকালীন সচিব প্রয়াত গৌতম বসুর বাড়িতে। সোমেন-অনুগামী কংগ্রেস বিধায়কদের ভোটও পান তৃণমূলের প্রার্থী জয়ন্ত ভট্টাচার্য। ফল বেরনোর পরে মমতা বলেছিলেন, “মহাজোটের জয়!”

রাজনীতির বিচিত্র ধারাপথে সোমেনদা নিজেও পরে তৃণমূলে এসে লোকসভার সাংসদ হয়েছিলেন। আবার মমতার সঙ্গে মতভেদে মেয়াদ ফুরানোর আগেই সব ছেড়ে ফিরে গিয়েছিলেন কংগ্রেসে। সবাই তা জানেন।

হ্যাঁ, সোমেন মিত্র কংগ্রেস নেতা হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু তিনি যে বার বার গোপনে নিজের দলের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, সেটা ভুলে যেতে হবে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Somen Mitra Mamata Banerjee Congress Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE