Advertisement
E-Paper

সিকিম যা করে দেখিয়েছে

আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক নেতানেত্রী কিংবা প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যে পরিবেশ চেতনার কোনও বালাই নেই। পরিবেশ রক্ষা আমাদের এই রাজ্যে অতি গৌণ বিষয়।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০৫

মাস কয়েক আগের কথা। বোলপুরে রাস্তার ধারে বড় বড় কিছু গাছ কাটছিল প্রশাসন। বিশ্বভারতীর কিছু ছাত্রছাত্রী এসে কয়েকটি গাছকে জড়িয়ে ধরে সেগুলিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। অদূরে দাঁড়ানো এক শাসক দলের নেতাকে সেই সময় এক পুলিশ কর্তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ভাল করে ঠেঙিয়ে ওদের সরিয়ে দিন। তার পর গাছ কাটুন। ওই গাছগুলিকে আর বাঁচানো যায়নি।

প্রশ্ন উঠেছিল, গাছগুলিকে কি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া যেত না?

আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক নেতানেত্রী কিংবা প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যে পরিবেশ চেতনার কোনও বালাই নেই। পরিবেশ রক্ষা আমাদের এই রাজ্যে অতি গৌণ বিষয়। তাই পনেরো বছরের বেশি পুরনো সরকারি গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। গ্রামবাংলার মাটি থেকে কোথাও ওঠে আর্সেনিক, কোথাও বা ফ্লুয়োরাইডের বিষ। শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠে সিসের তৈরি সামগ্রী, বা অ্যাসিড দিয়ে সোনা বা অন্য ধাতু গলানোর কারখানা।

পরিবেশের ব্যাপারে এই সরকারি ঔদাসীন্য বামফ্রন্ট আমল থেকেই। তৃণমূল আমলেও খুব একটা উন্নতি হয়নি। আগের মতোই কোনও মন্ত্রীর অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের সঙ্গে ‘ফাউ’ হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয় পরিবেশ দফতর। দ্বিতীয় তৃণমূল সরকারের আমলে প্রথমে এই দফতরের দায়িত্বে ছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার মেয়র, দমকল মন্ত্রী, আবাসন মন্ত্রী, তার সঙ্গে ‘বাড়তি’ হিসেবে পরিবেশ। এখন পরিবেশ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পরিবহণ দফতরের সঙ্গে ‘গুরুত্বহীন’ ওই দফতর।

রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল যদি পরিবেশ নিয়ে ভাবে, তা হলে একটা রাজ্যের হাল কতটা বদলে যায় তার প্রমাণ কিন্তু রয়েছে আমাদের হাতের কাছেই। সিকিম। ১৯৯৮ থেকে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হয়েছে সিকিমে। এবং সেই উদ্যোগ ১০০ শতাংশ সফল। তারা এখানেই থেমে থাকেনি। সব ক্ষেত্রেই ‘দূষণ মুক্ত রাজ্য’ হয়ে উঠতে একের পর এক পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এই সূত্রেই ‘‘গাছকে ‘বন্ধু’’ বানানোর এক কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। রডোডেনড্রন গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন পবন কুমার চামলিং। তাই সিকিমের কোথাও রডোডেনড্রন গাছে হাত দেওয়া নিষিদ্ধ। ডাল ছিঁড়লেই হইহই করে ছুটে আসবে পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে জরিমানা। চামলিং চান, রাজ্যের প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনও গাছকে বন্ধু বানাক। গাছকে ভাই, বোনের সম্পর্কে বাঁধার ডাকও দিয়েছেন টানা ২৩ বছর ক্ষমতায় থাকা মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘যে সব গাছের শিকড় খুব গভীরে যায় সেই গাছ কাটা আমরা নিষিদ্ধ করে দিয়েছি।’’ নিজেদের বাঁচাতেই যে পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজন, গোড়া থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মাথায় সেটা ঢুকিয়ে দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী। তার ফলও মিলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, দেশে সিকিমই একমাত্র রাজ্য যেখানে গত পাঁচ বছরে জঙ্গল বেড়েছে চার শতাংশ।

সিকিমে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। রাজ্যের প্রয়োজন মিটিয়ে বাকিটা জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করে সিকিম। তিস্তার জলধারাকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি হওয়ায় দূষণ হয় না। দূষণহীন আরও এক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পথে এগোচ্ছে ওই রাজ্যটি। সিকিমের বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমাদের আর বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই। তবুও আমরা সৌর বিদ্যুতের দিকে এগোচ্ছি। সৌর বিদ্যুৎ বিক্রি করে আমাদের বেশ কিছুটা আয়ও হতে পারে।’’

চাষের কাজে সিকিমে শুধুমাত্র জৈব সারই ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি দফতরের মন্তব্য, ‘‘এই শতকের গোড়াতেই ঠিক করেছিলাম, মাটি ও পরিবেশের দূষণ রুখতে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে দেব আমরা। প্রথমে আমরা ঠিক করি, রাসায়নিক সার ব্যবহারে কেন্দ্রীয় সরকার যে ভর্তুকি দেয় সেটা আমাদের কোনও কৃষক নেবেন না। বিকল্প হিসেবে আমরা জৈব চাষের রাস্তা দেখাই। এখন জৈব চাষই সিকিমে দস্তুর।’’

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে অনেক রাজ্যই, একমাত্র নির্ধারিত স্থানেই ধূমপান করা যায়। এ ক্ষেত্রেও বাকি রাজ্যদের পিছনে ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যটি। পথে বিভিন্ন জায়গায় ধূমপায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে ধূমপানের জন্য পাঁচ টাকা করে কর গুনতে হয়। এই সূত্রে আদায় করা টাকাটা ব্যবহার করা হয় রাজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে। রংপো-র চেক পোস্ট পেরিয়ে সিকিমে ঢুকতেই ধূমপানের ব্যাপারে সতর্ক হতে হয় পর্যটকদের।

সিকিমে ঘুরছি। এক জায়গায় থেমেছে গাড়ি। পর্যটকদের অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের গায়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন হালকা হতে। হাঁ হাঁ করতে করতে ছুটে এলেন গাড়ির চালক, ‘‘খবরদার এখানে নয়। এ সবের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা করা আছে। দয়া করে সেখানে চলুন।’’ রাস্তায় শত অনুরোধ সত্ত্বেও নির্দিষ্ট জায়গার আগে আর দাঁড়ালেন না চালক। যেখানে সেখানে হালকা হতে গিয়ে ধরা পড়লে মোটা টাকার জরিমানা দিতে হবে। জরিমানা দিতে হবে এমনকী সংশ্লিষ্ট গাড়ির চালককেও।

পরিবেশ নিয়ে তাঁরা কতটা ভাবছেন তা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী চামলিং কিছু দিন আগে কলকাতা থেকে যাওয়া এক সাংবাদিক দলের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপে বলেছিলেন, প্রতিটি দফতরকে তাদের বাজেটের এক শতাংশ পরিবেশের উন্নয়নের জন্য আলাদা করে রাখতে বলা হয়েছে।

তবে, এত কিছুর পরেও, দেখা গেল, গ্যাংটকেই গন্ডগোল। অগস্টের চতুর্থ সপ্তাহে রাজ্য রাজধানীতে রীতিমতো গরম। বলেকয়ে টেবিল ফ্যান এনে লাগাতে হল ঘরে। হোটেল, সচিবালয়, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি, কোথাও বাতানুকূল ব্যবস্থা নেই। কলকাতার হালকা পোশাকেই ঘামছি সবাই। যতই পরিবেশ নিয়ে ভাল কাজ হোক, গ্যাংটক শহরে ঢুকতেই দেখা গেল, পথের দু’ধারে উঠছে বহুতল। বছর দশেক আগে যেখানে ছিল গাছের সারি, ছোট পাহাড়ি বাংলো, সেখানে এখন কংক্রিটের জঙ্গল। শহরের এই অস্বাভাবিক গরম যে অত্যধিক নগরায়নের ফলেই, তা জানেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিকাশের আর এক নাম বিনাশ। সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। ব্যাপারটা আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই কিছু একটা করতে হবে।’’

সিকিম যে পথে এগোচ্ছে, আমরা কি তার সিকিভাগও অনুসরণ করতে পারি না? পশ্চিমবঙ্গের এক পরিবেশ কর্তার মন্তব্য: ‘‘পরিকল্পনা যেগুলি রয়েছে, সেগুলিই কার্যকর হতে পারছে কোথায়?’’

Environment Tree Pollution Sikkim
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy