শান্তিনিকেতন আমাদের কোলেপিঠে করে বড় করেছিল। অজান্তেই তৈরি করে দিয়েছিল দেখার চোখ। আর ভিতরের মনকে খুব যত্নে গড়ে তুলতে গিয়ে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল সামান্যের মধ্যে রয়েছে ‘এক নিমেষের অসামান্য’ আলোক। সেই আলোকে খুঁজে নেওয়া চাই। তাই আমাদের মাথার উপরের খোলা আকাশটাকে শুধু তো একটা আকাশ মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এই হল আমাদের মুক্তি। পাঠভবনে পড়ার দিনগুলোয় আমাদের মুক্ত মন দেখেছিল ও শিখেছিল প্রকৃতির ভিতরের সৌন্দর্যকে সহজে আপন করার মন্ত্র। তাই প্রকৃতির কোলে একটা করে ঋতু আসত আর দেখতাম আমাদের ইস্কুল তাকে হেসে-খেলে খুব সহজে বরণ করে নিচ্ছে। আমরাও যোগ দিতাম সেই আনন্দ-উৎসবে। সে আমাদের একেবারেই ঘরোয়া উৎসব। তার মধ্যে কোনও বাহুল্য নেই। নেই কোনও আড়ম্বর। গাছপালা যেমন সহজ, স্বাভাবিক ছন্দে ফুল ফুটিয়ে সৌন্দর্য্য ছড়ায় সীমায়-অসীমে, তেমনই শান্তিনিকেতনের উঠোনে ঋতু উৎসবগুলিও আপন ছন্দে বয়ে যেত। বিশেষ করে বসন্তোৎসব। আমাদের শৈশবের বসন্তোৎসবের ছবিটা বড্ড সহজ-সরল, আড়ম্বরহীন।
আড়ম্বর শব্দটার একটা অর্থ ‘মহারব’, জানিয়েছিলেন এই শান্তিনিকেতনেরই কৃতী মানুষ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’)। এই মহারব বা আড়ম্বরকে বাদ দিয়ে এ ভূমের বসন্তোৎসবের কথা দিনলিপিতে শুনিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (‘রবীন্দ্রভবন’-এ সংরক্ষিত)। ইংরেজি হরফে লেখা ‘বসন্তোৎসব’ শিরোনামে (মার্চ, পূর্ণিমা, ১৯২৯) সে বছরের উৎসবের বিবরণ দিচ্ছেন তিনি। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ বিদেশে। রথীন্দ্রনাথই সামলাচ্ছেন যাবতীয় দায়িত্ব। দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা এই খাতায় লিখেছেন তিনি। সেখানেই উৎসবের সারা দিনটির ছবি আঁকছেন রথীন্দ্রনাথ, ‘আজ সকালে ভোর থেকে উৎসব শুরু হয়েছিল। ৬টার সময় আমতলায় সকলে উপস্থিত হয়েছিলেন। অমিয়বাবু বসন্ত থেকে কবিতা আবৃত্তি করলেন- তারপর নিরুপমা দেবী ও নুটু সুন্দরের নাটকের অংশ অভিনয় করলেন – তার সঙ্গে মেয়েরা কিছু নাচ ও গান করলো। বেশ হয়েছিল। অভিনয় শেষে আবির খেলা ও ছেলেদের গান অনেকক্ষণ হোলো।’ ‘আমতলা’ এই শব্দের ব্যবহারেই অনাড়ম্বর উৎসবটি যেন বেশ মিষ্টি, ঘরোয়া হয়ে ওঠে।
পাঠভবনের আমরা প্রথম বসন্তেই বুঝেছিলাম, শান্তিনিকেতনের এই উৎসবটি আসলে ঋতু বসন্তের উদ্যাপন। তা কোনও ভাবেই হন্তদন্ত ‘হোলি’ নয়। তখন অনুষ্ঠানটা হত গৌরপ্রাঙ্গণের মঞ্চে। বসন্তোৎসবের দিন সকালবেলায় শান্তিনিকেতন বাড়ির পাশ থেকে শুরু হত নাচের শোভাযাত্রা। আমরা হলুদ পোশাকে, গানের সঙ্গে নাচ করতে করতে এসে বসতাম মূল মঞ্চের সামনে। প্রাঙ্গণ-মঞ্চের মাথায় ছাতার মতন দাঁড়িয়ে থাকত বাঁ-পাশের জাম গাছের ডাল। একের পর এক ‘বসন্ত পর্যায়’-এর গানে ও নাচে ভরে উঠত চত্বর। অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ শেষ হলে, তবেই হত একে-অপরকে আবির ছোঁয়ানো। কপালে ছোঁয়ানো আবির তো শুধু আবির নয়, তার মধ্যে মিশে থাকত রঙিন বসন্তের শুভেচ্ছাবার্তাও। ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়ত আর এক প্রস্থ নাচ-গানের আসর। বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মাস্টারমশাইরাও আশ্রম প্রাঙ্গণ জুড়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো ছোটো ছোটো দল করে গাইতে শুরু করতেন। বসন্তোৎসবের সকালবেলাটায় দেখা যেত, শান্তিনিকেতন এ ভাবেই খুব সহজে নাচে, গানে, রঙে রঙিন হয়ে উঠছে। সূর্য পাটে ঢলে পড়ার মুখে গৌরপ্রাঙ্গণেই মঞ্চস্থ হত রবীন্দ্র-সৃষ্টি, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘শ্যামা’...।