Advertisement
E-Paper

ওঁদের কাছে শিক্ষা নিন

এ কথা ঠিক যে, সওয়া শো কোটি মানুষের দেশ ভারতে কয়েক হাজার, কয়েক লক্ষ মানুষের প্রকাশ্য আন্দোলনে নামা থেকে সর্বভারতীয় স্তরে সমাজ বদলের সংকেত পাওয়া কঠিন।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৮ ০৬:১০

১৭৮৯-৯৯-এর ফরাসি বিপ্লবের সময় উদ্ভূত এই শব্দটা কালক্রমে এত বিপুল মানুষের দ্বারা এবং এত অগণন লোক সমুদায় সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে যে, কোনও একটি মাত্র অর্থের কোটরে একে আটকে রাখা যায়নি। দার্শনিক ভিত্তি এবং রাজনৈতিক অনুশীলন, দু’দিক দিয়েই যথার্থ বামপন্থা আবশ্যিক রূপেই বহুত্ববাদী। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর ধারণাগত অন্তর্বস্তু একটাই ব্যাপক রাজনৈতিক কর্তব্যকে সামনে রেখে এগিয়েছে: সামাজিক সাম্য ও ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠা, যার জন্য সমাজ পরিবর্তন অপরিহার্য। সে পরিবর্তন সব চেয়ে ভাল ভাবে আসতে পারে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যত দিন বিপ্লব না হচ্ছে, পরিবর্তনের চেষ্টাগুলোকে থেমে থাকতে হবে। বরং, সেই উদ্যোগগুলোকে আরও জোরদার করে অন্যায্যতা, অসাম্য যতখানি কমানো যায় তার প্রয়াসে লেগে থাকা জরুরি। এই লেগে থাকার মধ্যে সংসদের ব্যবহার বিভিন্ন জায়গায় কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে, কিন্তু কেবল নির্বাচনের ভিতর দিয়ে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন কোথাও হয়নি, এর জন্য মানুষকে নিরন্তর পথে নামতে হয়েছে। বস্তত, এ-কাজে সংসদের বাইরের রাজনীতির ভূমিকা অনেক বেশি। মহারাষ্ট্রের কৃষক জনসাধারণের বামপন্থী রাজনীতিতে সংগঠিত হওয়াটা এই প্রাসঙ্গিকতাকে আবার সামনে তুলে আনল।

এ কথা ঠিক যে, সওয়া শো কোটি মানুষের দেশ ভারতে কয়েক হাজার, কয়েক লক্ষ মানুষের প্রকাশ্য আন্দোলনে নামা থেকে সর্বভারতীয় স্তরে সমাজ বদলের সংকেত পাওয়া কঠিন। বিশেষত, যেখানে কোনও রাজনৈতিক মতবাদ বা দাবির পক্ষে সমর্থনের মাত্রা মাপবার জন্য নির্বাচনী সফল্যকেই প্রধান সূচক হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছে, এমনকী বামপন্থীদের বড় অংশটির পক্ষ থেকেও। কিন্তু, বামপন্থা তো শুধু নির্বাচনী গণতন্ত্রের ব্যাপার নয়, বস্তুত, সেটা তার ব্যাপকতর কর্মকাণ্ডের একটা ছোট অংশ মাত্র। সেই কর্মকাণ্ড থেকে কখনও নির্বাচনী সাফল্য আসতেও পারে, যেমন এসেছে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাতে। বিপরীতে, রাজনৈতিক আন্দোলনে গতিহীনতা বামপন্থীদের সংসদীয় প্রতিনিধিত্বে হ্রাসও ঘটাতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দাবিতে আন্দোলন থেকে সর্বদা এবং সর্বত্র নির্বাচনী সাফল্য আসবেই এমন কোনও কথা নেই। বিষয়টা নির্ভর করে স্থানীয় জনবিন্যাস, আর্থনীতিক গড়ন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর। এবং, সে-কারণে বিধানসভায় বা লোকসভায় কত জন নির্বাচিত হলেন, বা কতগুলো পঞ্চায়েত বা পুরসভা ‘দখল’ করা গেল, তা দিয়ে বামপন্থার লোকসমর্থন মাপতে যাওয়াটা আর যা-ই হোক বামপন্থী পদ্ধতি হতে পারে না। ইন্দিরা গাঁধীর ফ্যাসিবাদী শাসনকালে, এবং কিছু পরিচিতিভিত্তিক আন্দোলন বাদ দিলে ভারতে সাধারণ মানুষের স্বার্থে যে-সব আন্দোলন গড়ে উঠেছে, এবং যা দেশের সংসদ, আইন, ও প্রশাসনকে প্রভাবিত করেছে তার মূল ভিত্তি কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি। এমনকী জাতিগত নিষ্পেষণ বিরোধী, অম্বেডকরপন্থী বা আদিবাসী বঞ্চনার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তথাকথিত পাতি-বুর্জোয়া রাজনীতির মূল দার্শনিক ভিত্তিটাও মূল চরিত্রের দিক দিয়ে বামপন্থী।

এক কথায়, সংসদীয় বাম দলগুলোর নির্বাচনী ব্যর্থতা থেকে বাম রাজনীতির সাফল্য-ব্যর্থতা মাপা চলে না। দক্ষিণপন্থীরা পথে নামতে জানে না, তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে ভোটে জিতবার জন্য। আর যখন নামে সেটা মানুষের পক্ষে বা মানুষের জন্য নয়, রামমন্দির থেকে গুজরাত নিধনের মতো সভ্যতা-ধ্বংসী উদ্দ্যেশ্যে। উলটো দিকে, বামপন্থা নিজেকে সব চেয়ে ভাল ভাবে মেলে ধরতে পারে রাস্তায়, সবচেয়ে নিপীড়িত শ্রমজীবী, সর্বাপেক্ষা অবদমিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা আদিবাসী বা দলিতদের পক্ষে নানা পদ্ধতির গণ আন্দোলন সংগঠিত করে। ভারতের বামপন্থার চালকরা তাই নাশিকের শংকর ওয়াঘেরাদের বামপন্থার কাছে পাঠ নিতে পারেন। এতে তাঁদের যতটা মঙ্গল, তার চেয়ে বেশি মঙ্গল মানব সমাজের।

(শেষ)

social equality Kisan rally Society
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy