Advertisement
০২ অক্টোবর ২০২৩
সম্পাদকীয় ২

উন্নত শির

এই কণ্ঠস্বর ইরানেও বিরল নহে। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ প্রসঙ্গে তাই মাস কয়েক আগে ইরানের মাটিতে সংঘটিত প্রতিবাদের কথা স্মরণীয়।

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৮ ০০:৩৬
Share: Save:

ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পদার্পণ করা ইস্তক রমণীগণকে শির আচ্ছাদিত রাখিতে হয়। সেই দেশে আইন তেমনই। যে দেশ, যে বিশ্বাস, যে মূল্যবোধের নাগরিকই হউন না কেন, বেড়াইতে যান কিংবা খেলিতে, প্রকাশ্যে শির প্রদর্শন করিতে পারিবেন না কোনও রমণী। ব্যক্তিগত অধিকার হরণের এই অপনীতির প্রতিবাদ করিয়াছেন ভারতীয় দাবাড়ু সৌম্যা স্বামীনাথন। জানাইয়া দিয়াছেন, সেই হেতু ইরানে আয়োজিত এশীয় টুর্নামেন্টে তিনি যোগ দিবেন না। তাঁহার নিকট মানবাধিকার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। একই কারণ দর্শাইয়া বছর দুয়েক আগে এশীয় এয়ার গান মিট-এ যাইতে অস্বীকার করিয়াছিলেন আর এক ভারতীয় ক্রীড়াবিদ হিনা সিন্ধু। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি যদি কেহ এই ভাবে অস্বীকার করেন, ভাবিয়া দেখিতে হয়, তাহার পশ্চাতে কারণটি কত গভীর। প্রথম কথা, প্রতিটি দেশের, প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব পোশাকের ধরন ও রুচি রহিয়াছে। অন্য অঞ্চলের নাগরিকদের উপর দেশীয় আইন চাপাইয়া দেওয়া অত্যন্ত অসঙ্গত। কিন্তু মূল প্রশ্নটি গভীরতর। মূল প্রশ্ন ব্যক্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ। এই কারণেই প্রতিবাদী পদক্ষেপ করার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় অজস্র অভিনন্দন এবং সমর্থন মিলিয়াছে সৌম্যার। সুর কমবেশি এক রকম— দাবা খেলিতে গিয়া শির ঢাকিতে হইবে কেন? কী পোশাক পরিয়া দাবাড়ু স্বচ্ছন্দে ক্রীড়াঙ্গনে অবতীর্ণ হইতে পারিবেন, ইহা কেবল দাবাড়ুই নির্ধারণ করিতে পারেন। ধর্ম-সংস্কৃতির কারণে রমণীর শিরাচ্ছাদন। তবে অবস্থা যাহা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে ইহাকে শিরস্ত্রাণ বলিলেও ভ্রম হয় না— শিরকে বিপদ হইতে ত্রাণ দেওয়াই তাহার কর্ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে! আচ্ছাদন যদি বাধ্যতামূলক হয়, তবে তাহা শিরকে এক প্রকার ত্রাণই দেয়। সেই ত্রাণ গ্রহণ করেননি সৌম্যা-হিনা।

এই কণ্ঠস্বর ইরানেও বিরল নহে। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ প্রসঙ্গে তাই মাস কয়েক আগে ইরানের মাটিতে সংঘটিত প্রতিবাদের কথা স্মরণীয়। তেহরানের ভিদা মোভাহেদা নামক এক রমণী প্রকাশ্যে শিরাচ্ছাদন খুলিয়া হিজাব-আইনের প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন। তাঁহার প্রতি বহু রমণীর অকুণ্ঠ সমর্থন ঝরিয়া পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একই প্রকারের প্রতিবাদে সামিল হন আরও বহু। তেহরান হইতে বার্তা ছড়াইয়া পড়ে ইসফাহান-এ। বার্তাটি অতীব স্পষ্ট: রমণীগণ হিজাব পরিধান করিবেন কি করিবেন না, ইহা তাঁহাদের ব্যক্তিগত নির্বাচন। ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের পর হইতে ইরানে শিরাচ্ছাদন বাধ্যতামূলক, ফলে রমণীগণের প্রতিবাদ হইয়া দাঁড়ায় আইন-অমান্য আন্দোলন। এবং ‘বিপ্লব সরণির রমণীকুল’ বলিয়া চিহ্নিত এই প্রতিবাদে গ্রেফতারও হইতে হয় আইন-অমান্যকারীদের। আবার বিপ্লব-পূর্ববর্তী ইরানে শির আচ্ছাদিত করা ছিল অপরাধ। স্পষ্টতই, শির আচ্ছাদিত হউক অথবা অনাচ্ছাদিত, আইন কেবল রমণীর জন্য। নির্দেশ প্রদান যিনি করিতেছেন, তাঁহাকে সেই পোশাক গাত্রে চাপাইতে হয় না। আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ইহাই রীতি। অন্যায় রীতি। মেয়েরা কী পোশাক পরিবেন তাহা অন্য কাহারও, এমনকি রাষ্ট্রেরও, বলিয়া দেওয়া সমীচীন নহে। যে ব্যক্তি যে প্রকারে স্বচ্ছন্দ, সেটাই তাঁহার পোশাক। সেই পরিসরে ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাহারও প্রবেশ অনধিকার চর্চা। ইহা অগণতান্ত্রিক। গর্হিত অপরাধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE