Advertisement
E-Paper

অদম্য লড়াইয়ের এক নাম অরুণ লাল

এই জীবন-দর্শন শুধু ক্রিকেট কেন, জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও কাজে লাগে। কঠোর পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। যেমন বিকল্প নেই জংহীন ইস্পাততুল্য স্নায়ুর। লিখছেন সূর্যশেখর দাসঅবিশ্বাস্য পরিশ্রম এবং গ্রানাইটের মতো শক্ত মানসিকতার সুবাদে ধীরে ধীরে নিজেকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। বাংলা ক্রিকেট দলে আমদানি করলেন পেশাদারি কাঠিন্য। 

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:২৬
ক্রিজে যখন অরুণ লাল। ফাইল ছবি

ক্রিজে যখন অরুণ লাল। ফাইল ছবি

তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ার নিয়ে গণমাধ্যম মাতামাতি করে না। কারণ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর চমকপ্রদ সাফল্য নেই। ১৬টি টেস্ট তাঁর মোট সংগ্রহ মাত্র ৭২৯ রান। ব্যাটিং গড় মাত্র ২৬.০৩! সোশ্যাল মিডিয়া তাঁকে বেশি পাবেন না। তা ছাড়া, উনি যখন খেলেছিলেন তখন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারের অস্তিত্বই ছিল না।

তাঁর ব্যাটিংয়ে গাওস্করের টেকনিক, সচিনের রাজসিকতা, সৌরভের লাবণ্য হয়তো খুঁজে পাবেন না। পাবেন না গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের কাব্যিক কভারড্রাইভও। ওঁর ব্যাটিং বরং গদ্যময় মনে হতে পারে।

উনি যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতেন, আজকের তুলনায় অর্থ মিলত কম। আইপিএল দূর অস্ত্, স্বপ্নেও টি-টোয়েন্টি উঁকি দিত না। উনি বাংলা ক্রিকেটের এভারগ্রিন ফাইটার, মহারাজের প্রিয় পিগিদা, অরুণ লাল।

অরুণ লাল একটা সময় দিল্লির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন। ছ’বছর খেলেছিলেন। সে ভাবে সাফল্য মেলেনি। চাকরি সূত্রে চলে এলেন কলকাতায়। শহরটাকে ক্রমেই ভালবেসে ফেললেন। ব্যর্থতা ঝেড়ে বাংলার রঞ্জি দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন। অবিশ্বাস্য পরিশ্রম এবং গ্রানাইটের মতো শক্ত মানসিকতার সুবাদে ধীরে ধীরে নিজেকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। বাংলা ক্রিকেট দলে আমদানি করলেন পেশাদারি কাঠিন্য।

যখন দক্ষতা সমান-সমান হয়ে যায়, তখন মানসিকতাই ফারাক গড়ে দেয়। দিল্লি বা মুম্বই আগে অনেক ম্যাচে বাংলাকে স্রেফ স্নায়ুর লড়াইয়ে হারিয়েছে। অরুণের অদম্য মনোভাব বাংলা দলে অত্যন্ত ইতিবাচক ভাবে সংক্রমিত হল। মানসিক পরিবর্তনের দৌলতে বাংলা ১৯৮৯-’৯০ মরসুমে দ্বিতীয় বার রঞ্জি ট্রফি জিতল বাংলা। ওই মরসুমেই কোয়ার্টার ফাইনালে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে অরুণের অপরাজিত ১৮৯ বাংলা ক্রিকেটের লোকগাথার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফাইনালে প্রবল প্রতিপক্ষ দিল্লির বিরুদ্ধে অরুণের ব্যাট মুখরিত হয়েছিল। বাংলার এই রঞ্জি ট্রফি জয় এটা প্রমাণ করেছিল যে দিল্লি, কর্নাটক বা মুম্বইয়ের মতো বাংলাও তা হলে শক্তপোক্ত, ‘খারুস’ ক্রিকেট খেলতে পারে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অরুণের প্রত্যাশিত সাফল্য পাননি। যদিও অভিষেক টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৬৩ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস খেলেছিলেন। ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে করেছিলেন ৯৩, যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর। মাত্র ১৬টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচকদের দোষারোপ করেননি।

জীবনযুদ্ধেও হারতে অরুণ লাল শেখেননি। ভাঙা গোড়ালি নিয়ে, যন্ত্রণায় নীল হয়েও, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে সেই অপরাজিত ১৬৪ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস আজও বিশ্ববিদ্যালয়-ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ২০১৬-এর গোড়াতেই যখন উনি বিরল চোয়ালের ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন তখন মৃত্যু হয়তো ভেবেছিল গলা টিপে মারবে। উল্টে ফাইটার অরুণ নক আউট করে ক্যানসারকে রিঙের বাইরে ফেলে দিলেন। এ বাংলা ক্রিকেটে ‘ফাইটার’ লাল আবার প্রবল উদ্যমে ফিরে এলেন। এখন উনি বাংলা দলের কোচ। মনোজ তিওয়ারি থেকে অভিমন্যু ঈশ্বরণ, ঋদ্ধিমান সাহা থেকে অশোক দিন্দা— বাংলার ক্রিকেটারদের সফল হওয়ার পাঠ দিচ্ছেন। সিএবি যুক্তিসংগত কারণেই এ বারে তাঁকে জীবনকৃতি সম্মান দিয়েছে। অরুণের জীবন বলে, কঠোর পরিশ্রম কর। মনটাকে ইস্পাতের মতো কঠিন করে তোল। স্নায়ুবিক দুর্বলতা যেন তোমাকে পিছিয়ে না দেয়।

অরুণের এই জীবন-দর্শন শুধু ক্রিকেট কেন, জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও কাজে লাগে। কঠোর পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। যেমন বিকল্প নেই জংহীন ইস্পাততুল্য স্নায়ুর। অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতেও লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়। কোন মতেই নিজের উপরে বিশ্বাস হারাতে নেই। ক্যানসারকে ছক্কা মেরে মাঠের বাইরে ফেলে দিয়ে তাইতো অরুণ স্বপ্ন দেখেন যে আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে বাংলা দল আবার রঞ্জি ট্রফি জিতবে। ওঁর কাছে জীবন মানে এক অদম্য আশাবাদের আখ্যান। নেপোলিয়নের সমসাময়িক কার্ল ভন ক্লজউইটজ় যুদ্ধের উপরে বই লিখেছিলেন। ভয়ঙ্কর যুদ্ধে জিততে যে অদম্য লড়াই, অপরাজেয় মানসিকতা, নির্ভুল একাগ্রতা, উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস এবং সহযোদ্ধাদের প্রতি সুদৃঢ় সহমর্মিতার প্রয়োজন সে কথা লিখেছেন। ওঁর লেখা বইটির নাম ‘অন ওয়ার’। বঙ্গ ক্রিকেটের উপর এই ধরনের কোন বই লিখলে সেই বইয়ের নাম হতেই পারে ‘অন অরুণ লাল’।

লেখক শ্যামসুন্দরপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক

Arun Lal Indian Cricketer অরুণ লাল Indian Cricket
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy