সত্তর বছর-প্রায় কবিজীবনে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বহু বার দিকবদল করেছেন তাঁর কবিতাযাত্রায়। শেষ দিকবদল দুই শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে, যখন, তাঁরই নিজের কথায়— কবিতাসংগ্রহ-র তৃতীয় খণ্ডের সূচনায় তাঁর ‘মিতভাষ’-এ— “মার্কিন আগ্রাসনের দাপটে ঘনিয়ে এল গাল্ফ্ যুদ্ধ, আমার জন্য রেখে গেল পূর্বধার্য কাব্যমীমাংসার বদলে চ্যালেন্জ্সঞ্চারী কাব্যজিজ্ঞাসা। বিশেষত এই সংগ্রহের শেষ দুটি বইতে আমার প্রতীতি ও অনাস্থার সেই দোলাচল লুকিয়ে থাকেনি, আমার ঘনিষ্ঠ পাঠকদের কাছে এই তথ্যও গোপন থাকেনি যে জগৎজোড়া শরণার্থীদের সঙ্গেই আমি তখন থেকে অষ্টপ্রহর সম্পৃক্ত হয়ে আছি।” বার বার দিকবদলেও কিন্তু অব্যাহত অবিচল— ও সমান সজীব— থাকে তাঁর অমোঘ মুদ্রাগুণ, শব্দনির্মাণের ঝলকানি। তাঁর সদ্যবয়নে এই নতুন শব্দগুলি— না কি শব্দবন্ধই— যে তাৎক্ষণিক দ্যুতিতে ফেটে পড়ে পাঠকের অভ্যস্ত কাব্যচারণকেই ধ্বস্ত করে নতুন এক চিন্তায় তাকে প্ররোচিত করে, তার মধ্যে অলোকরঞ্জনের যে কাব্যদর্শন প্রোথিত, তার পরিচয় আছে একটি কবিতায়, যেখানে তিনি তাঁর প্রতিবাদী সত্তাকে বিস্ফোরণের প্রাক্মুহূর্তে এনে দাঁড় করান। তিনি বলেন: ‘আমি তোমাদের এখন যা কিছু বলছি সে সমস্তই পাথরের অবরুদ্ধ চিৎকার। তোমরা ডিনামাইট দিয়ে আমাকে বিস্ফারিত করলেই আমার প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে পারবে। উদয়াস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখে ফেনা তুলে কথা বলে চলেছিলাম। তাতে কোনোই ফল হয়নি। এখন স্নায়ুশিরার ভাঁজে ভাঁজে জমিয়ে রাখি যাবতীয় বিক্ষোভ। একটু আগেই যারা গঞ্জের কিশোরদের মাথা মুড়িয়ে অকালভিক্ষু বানিয়ে দিল তাদের বিষয়েও বিবমিষা বুনে রেখে দিয়েছি এই শিলার অন্তঃশরীরে... তোমাদের শুধু প্রথমে পাথরটাকে পাথর বলে শনাক্ত করতে ঈষৎ বেগ পেতে হবে। কারণ তাকে ঘিরে রয়েছে এখন সাতসতেরো প্রাচীরলিপি আর বিজ্ঞপ্তি।... এই সমস্ত আগাছা সরিয়ে তবেই কিন্তু ডিনামাইট দিয়ে তোমাদের দীর্ণ করতে হবে আমাকে। শুধু সতর্ক থেকো, ভালোবেসেই বিস্ফোরণের কাজটা ঘটাতে হবে।’
শব্দনির্মাণের মুদ্রাটি ছাড়াও আরও একটি মুদ্রাকে অলোকরঞ্জন তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষার অঙ্গ করে নিয়েছিলেন— কবিতার জন্মমুহূর্তের দ্যোতনাকে তিনি প্রায়ই স্থাপন করেন এক পটচিত্রকথার বয়নে, যাতে স্মৃতি থেকে উঠে আসে ইতিহাস-পুরাণ-বর্তমানের নানা চরিত্র, কখনও চেনাজানা সমকালীন মানুষও, কল্পভূমিকায়, কল্পভাষে; কখনও বা সরাসরি ব্যক্তিস্মৃতির বাস্তবতায়; অনুষঙ্গরূপকের এক বিচিত্র মাত্রায়: নিজের সদ্যপ্রয়াত মেজো ভাই ‘ঊর্ণাতন্তুময় সাজ খুলে ফেলে/ অন্তরীক্ষে মিশে যাবার আগে/... আমার দিকে তাকিয়ে হাসল/ ভাবখানা এই: কেমন মজা?’ কিংবা তৃপ্তি মিত্র: ‘এলা, নন্দিনী অথবা সুদর্শনা/ কে আপনি? এই সাজলেন বুলু আর/ এই ফুলওয়ালি। নিচু উলুখাগড়ার/ পরেই সবিতা কাঞ্চনরঙ্গনা,/ উদয়াচলের সূর্যের দুর্বার/ রক্তকরবী যক্ষপুরীতে, যার/ পাপড়িতে বাজে দয়া আর ভর্ৎসনা/ একাধারে। সূর্যাস্তের পরগনা/ হায়দ্রাবাদের সেমিনারে নেমে এলে/ আমি ও শমীক স্মিত চকমকি জ্বেলে/ ভেবেছি শুধাব এই সমস্ত কথা...’; আমার কোনও ‘অনুবাদের ওয়ার্কশপে’ ‘আমি শুধুই বলেছিলাম অন্ধকারে জ্বলতেছে চেরাগ—/ ওরা বলল চেরাগের বদলে/ প্রদীপ বললে ন্যায্য হত, অরুণ মিত্র বললেন পিদ্দিম...’ অলোকরঞ্জন এই কুশীলবদের যে কল্পপটে পুনরুজ্জীবিত করেন, তাতে তাঁরা তাঁদের উপস্থিতির সঙ্গে নিয়ে আসেন সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমান্বয়তার রেশ, না কি প্রচ্ছন্ন সূত্র।
সমকালের দুঃসময়ের ছায়াঘোর বিভ্রান্তির মধ্যে আলোকচ্ছটার মতো জ্বলে উঠে এই মুহূর্তগুলি কবিতার মধ্যে যে নাটকীয় মাত্রা সৃষ্টি করে, তার মায়ায় মজে অলোকরঞ্জন কখনও কখনও নাট্যকণিকাও সৃষ্টি করেন, তাঁর ভাষায় ‘সংলাপিকা’। এমনই একটি সংলাপিকা ‘বাঁশের কেল্লাটা চলছে’-য় তিতুমিরের বিদ্রোহের তাৎপর্য বিচার করে দুই কিশোর, সাক্ষী হিসেবে তারা পেয়ে যায় বর্তমানে আর ঐতিহাসিক অতীতে অনেক কল্পকুশীলব, তর্ক-মতান্তরে প্রাণবন্ত সওয়াল জবাব, আবার এক ত্রিকালদর্শী গনতকার যে দেখে আর এক কাল, যখন “এখন সবারই তিতুমীর নাম।/ এ গাঁয়েই কেন, যেখানেই যাও—/ হাসনাবাদে বা বেড়াচাঁপা গাঁয়ে/ হাড়ুয়া বাঁশবেড়ুর তলায়/ সব জায়গায় সব জায়গায়/ ছেলেরাই কেন, যত বুড়োরাও তিতুমীর নাম সম্বল করে/ মরতে চলেছে। আমার নিজেরও/ তিতুমীর নাম, ধরে বেঁধে নিয়ে মেরে ফ্যাল তোরা আমায়, তবুও/ নামটা বিকিয়ে দিতে পারব না।” তথ্য, তত্ত্ব ও ভাবনা নিয়ে এই দ্বন্দ্বজটিল বিচারপর্ব শেষে, যেন স্থিতি-প্রতিস্থিতির বিরোধ পেরিয়ে সংস্থিতিতে পৌঁছে তারুণ্যে উপনীত কিশোর সিদ্ধান্তে পৌঁছয়: “সে ছিল শহিদ সে ছিল প্রেমিক/ আর এই দুই সত্তা যখন/ মিলে মিশে যায় এক মোহানায়/ মহাবিপ্লবী শুধু তাকে বলা যায়।”