Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শ্যালিকাদের বলেন বিভূতিভূষণ, ‘বাঁচতে চাইলে গান করো’ 

প্রথমে ঝাড়গ্রাম দেখতেন ট্রেনের জানলা দিয়ে। পরে শ্বশুরবাড়িই হয়ে গেল অরণ্যশহর। যাতায়াত বাড়ল। প্রকৃতির টানে পথে পথে ঘোরা। মজার স্মৃতি জড়ো হল দিনলিপিতে, গুণমুগ্ধের স্মৃতিচারণায়। লিখলেন মৃন্ময় হোতা নভেম্বেরে ঝাড়গ্রাম থেকে কল্যাণীকে ঘাটশিলায় নিয়ে যান। নিজে এসেছিলেন না কেউ কল্যাণীকে পৌঁছে দিয়েছিলেন তা জানা যায় না।

সাদা বাড়ির চত্বরেই ছিল বিভূতিভূষণের শ্বশুরবাড়ির প্রথম বাসা। পাশে সর্বাধিকারীদের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

সাদা বাড়ির চত্বরেই ছিল বিভূতিভূষণের শ্বশুরবাড়ির প্রথম বাসা। পাশে সর্বাধিকারীদের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০০:৫৫
Share: Save:

ঝাড়গ্রামের পথ ‘পথের কবি’ বিভূতিভূষণকে সত্যিকারের ডাক দিল ঘটনাচক্রে। ১৯৪২ সালে জন্মের তিন দিন পরে মৃত্যু হল মেয়ের। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ভেঙে পড়েন। লেখকের শ্বশুরমশাই ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আবগারি ইনস্পেক্টর। কর্মসূত্রে থাকতেন কোলাঘাটে। কল্যাণীকে ১১ জুলাই কোলাঘাটে পাঠিয়ে নিজে এলেন পুজোর সময়। সেবার পুজোর সময় হল ভয়ানক আশ্বিনের ঝড়। সবচেয়ে ক্ষতি হল মেদিনীপুর জেলার। এর পরই ষোড়ষীকান্ত বদলি হয়ে এলেন ঝাড়গ্রামে। কল্যাণীকে ঝাড়গ্রামে পাঠিয়ে ভাইয়ের খোঁজ নিতে এলেন ঘাটশিলায়। নভেম্বেরে ঝাড়গ্রাম থেকে কল্যাণীকে ঘাটশিলায় নিয়ে যান। নিজে এসেছিলেন না কেউ কল্যাণীকে পৌঁছে দিয়েছিলেন তা জানা যায় না।

১৯৪৩ সালের শুরুতে আবার এলেন চাঁইবাসা–সরাইকেলা অঞ্চলে। ৯ জানুয়ারি কল্যাণীকে ঘাটশিলায় রেখে চাঁইবাসার ইঞ্জিনিয়ার সুবোধ ঘোষের মোটরে নুটুকে নিয়ে ধলভূমগড়, চাকুলিয়া দিয়ে ঝাড়গ্রামে এলেন। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘বিহার ছাড়ালুম বাংলা আরম্ভ হোল। তালগাছ, নারিকেল গাছ। বাংলার খড়ের ঘর। বাংলা মায়ের উদ্দেশে প্রণাম করি। কইজুড়ি (দইজুড়ি) বলে একটা গ্রাম পথে পড়ে। ঝাড়গ্রাম পৌঁছে নুকুর সাথে মায়াদির (বড় শ্যালিকা) দেখা পথেই। রাজার বাড়ী ও সাবিত্রী মন্দির ঘুরে চা ও খাবার খেয়ে বেলুকে (কল্যাণীর পরের বোন) নিয়ে তখুনি রওনা’।

১৯৪৩ সালে জানুয়ারি মাসের গোড়ায় চাঁইবাসার বাংলা সাহিত্যর অনুরাগীদের ডাকে স্ত্রীকে নিয়ে বিভূতিভূষণ চাঁইবাসা যান। আলাপ হয় যোগেন্দ্রনাথ সিংহের (ধলভূমগড়ের বিএফও) এবং হরদয়াল সিং (কোলহান ডিএফও) এর সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়ার সুবোধ ঘোষ এঁদের বিভূতিভূষণ পড়ে শোনাতেন। তাই তাঁরা বন পাগল বিভূতিভূষণকে সিংভূমের অনাঘ্রাত গভীর অরণ্য দেখার আমন্ত্রণ জানালে তিনি উৎফুল্ল হন। ৫ জানুয়ারি সরাইকেলার রাজবাড়ি দেখে হলুদ বিকেলে একটি অল্প উচ্চ স্লেট পাথরের সুন্দর টিলা দেখে বন্ধুরা নামকরণ করলেন ‘বিভূতি শৈল’।

কল্যাণীর মন প্রকৃতির স্পর্শে সজীব হয়। কিন্তু একটানা বন–পাহাড় ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাই ৯ জানুয়ারি বিভূতিভূষণ চাঁইবাসা থেকে মোটরে ঝাড়গ্রাম এলেও কল্যাণী ঘাটশিলায় থেকে যান। মাসের একটা সময় রসদ সংগ্রহের তাগিদে তাঁকে কলকাতায় প্রকাশকদের কাছে যেতে হত। তাই কল্যাণী ঝাড়গ্রামে যেতে চাইলে ১ ফেব্রুয়ারি ভোরের ট্রেনে শ্যালিকা বেলু, গুটকে (বন্ধুপুত্র অজিত রায়) এবং কল্যাণীকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ঝাড়গ্রামে আসেন। শ্বশুরমশাই স্টেশনে ছিলেন। ওই ট্রেনেই কলকাতায় যান লেখক।

কলকাতায় ফিরে কর্মব্যস্ততার মাঝে মনে পড়ে কল্যানীর কথা। সেই স্বপ্নের ঘোর লাগা বন ভ্রমণের কথা। ৬ ফেব্রুয়ারি হাওড়া থেকে খড়্গপুর প্যাসেঞ্জার ধরলেন। ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নেমে রিকশা করে শ্বশুরবাড়ি। কল্যাণী খুব খুশি। বিকেলে কল্যাণীর জন্য কাপড় কিনে আনেন। আসলে সন্তান শোক ভোলানোর জন্য স্ত্রীকে নানা ভাবে খুশি রাখার চেষ্টা সব সময় করতেন। কিন্তু কল্যাণীর আক্ষেপ যায় না। রাতে স্বামীকে বলেন, ‘আমার যদি একটা খোকা থাকত’! ৭ ফেব্রুয়ারি ছোট শ্যালক দেবীদাসকে (বাদু) নিয়ে বিভূতিভূষণ গেলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঝাড়গ্রামের বাসায়। কিন্ত দেখা পেলেন না। সেবার ঝাড়গ্রামে থেকেছিলেন ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সকালে বাদুর সঙ্গে শালবনে বেড়ানো। বাসায় বড় ইঁদারা থাকলেও তাঁর পছন্দের স্নানের জন্য যেতেন রাজবাড়ির পুকুরে। বাঁধানো পুকুরপাড় দেখে মনে হয়েছিল, আহা দেশের পুকুরের (বিলবিলে) পাড় যদি এরকম বাঁধানো যেত! আর যদি রাজবাড়ির সামনের মতো রাস্তার দু’ধারে পাম প্যাভেলিয়ান করা যেত! বিকেলে সাবিত্রী পুকুরের পাশ দিয়ে চলে যেতেন বাণীভবনের রাস্তায়। কখনও সঙ্গী বাদু, শুবু। কখনও একলা। রাজবাড়ির সামনে দিয়ে যেতেন ‘কালাচুনি’ গ্রামে। একদিন বিকেলে রাজবাড়ির ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছিল। দেখা বোধহয় হয়নি। কারণ সে সময় ম্যানেজার দেবেনবাবুর উদ্যোগে গণ্যমান্য কেউ ঝাড়গ্রামে রাজবাড়িতে এলেই রাজাবাহাদুর তাঁকে অন্তত এক বিঘা জমি দিয়ে থাকার জন্য উৎসাহিত করতেন। ফলে অরণ্যশহরে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি বাড়ি করেছেন। এবং এলাকাটির উন্নয়নে যোগ দিয়েছেন।

সরস্বতী পুজো ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি। বিভূতিভূষণেরা অঞ্জলি দেন বাসার ঠিক উল্টোদিকে ঝাড়গ্রাম রাজ প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে আলাপ এক মৌলবির সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে বাজারে যান। ফেরার পথে আড্ডা দিতে যান বনগাঁর বাসিন্দা কান্তিবাবুর কাছে। কান্তিবাবু সাবরেজিস্টার ছিলেন। বিকেলে ঘাটশিলায় যাওয়ার জন্য ট্রেনে তুলতে আসেন কল্যাণী ও খোকা (বিভূতিভূষণের বড় শ্যালক তথা তাঁর অন্যতম জীবনীকার চণ্ডীদাস)। সারাক্ষণ ছোটবড় সবাইকে নিয়ে এত মজা করতেন যে উনি যাবার সময় সবার মন খারাপ হত। কল্যাণীর তো কথাই নেই। ট্রেনে ওঠার পরেও চেয়ে রইলেন স্বামীর যাত্রাপথের দিকে, যতক্ষণ দেখা যায়। সেই দৃষ্টিতে বিভূতিভূষণের কষ্ট হয়। আরও মায়া পড়ে কল্যাণীর উপর।

এদিকে খ্যাতি বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে লেখার চাহিদা। বিশেষত ভ্রমণমূলক লেখার। বেড়াচ্ছেন অজানা সিংভূম, মানভূম বা লাগোয়া ওড়িশার ‘বনে-পাহাড়ে’। ২১ ফেব্রুয়ারি এলেন বহড়াগোড়া। সঙ্গী যোগেন্দ্র সিংহ। পরের দিন চিচড়া গ্রামের কাছে দুধকুণ্ডিতে। শুনলেন, ঝাড়গ্রাম মাত্র ৩০ মাইল। কল্যাণীর টান প্রবল হল। ফেকোঘাটে ডুলুং নদী কংক্রিটের চাতালের ওপর দিয়ে পেরিয়ে চন্দ্রীমোড়, নৌদাশোল (লোধাশুলি) এলেন ঝাড়গ্রামে। হঠাৎ আগমনে কল্যাণী তো বেজায় খুশি। পরবর্তীকালে, যোগেন্দ্রনাথ সিংহ বিভূতিভূষণের স্মৃতিচারনায় একটি বই লেখেন, ‘পথের পাঁচালী কে বিভূতিবাবু’। সেখানে এই দিনটির কথা লিখতে গিয়ে তিনি বলেছেন- ‘এদিকে তিন চার দিন যাবত বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তা কাঁচা ছিল ও নালার উপর পুল ছিল না। আমি বিভূতিবাবুর উৎসাহের রাশ টানতে পারি কিন্তু শ্বশুরবাড়ির টান তা মানবে কেন!...পথে কাউকে পেলেই বিভূতিবাবু রাস্তার খবর জিজ্ঞাসা করছেন। যেন সীতা-হারা রামচন্দ্র। ...আমাদের সবচেয়ে ভয় ছিল একটি বিশেষ নালার (ফেকো’র ডুলুং)।...নালার একটু আগেই এক বুড়ির সঙ্গে দেখা হল।...বুড়ি জলের পরিমাণ দেখাতে হাঁটুতে হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গি করে সুর করে বলল –“মাগো এত জল গো! কী করে পাঁরাবি গো?”...বিভূতিবাবুর মুখ শুকিয়ে গেল দেখে আমার মনে দয়া হল। হয়তো গুরু ভক্তি জেগে থাকবে। হনুমানের ভাব আর কী। মোটর যদি ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত না পৌছাতে পারে তবে ঝাড়গ্রামকেই তুলে এনে গুরুর চরণে অর্পণ করব’।

ঝাড়গ্রামে পৌঁছে ‘বিভূতিবাবু’ বাড়ি না গিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে গেলেন পরিত্যক্ত পুরাতন রাজবাড়িতে। বিকেলে আমরা মোটরে ঝাড়গ্রামের উত্তর দিকে বেড়াতে গেলেন। যোগেন, বিভূতি, কল্যাণী, মায়া ও তাঁদের দুই বোন ছিলেন। একটি নালার (সম্ভবত নহর খাল) কিনারে মোটর দাঁড় করিয়ে তাঁরা আড্ডা দেন। বিভূতিবাবু প্রস্তাব করেন, ‘একটি সুন্দর গান হোক’। প্রস্তাবে সকলে লজ্জায় এ ওর পিঠে মুখ লুকোচ্ছেন। বিভূতিভূষণ হাতের ছড়ি উঁচিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো, আমি মাস্টারি করি। এই ছড়ির ব্যবহার আমার জানা আছে। বাঁচতে চাও তো গান করো’। শেষ পর্যন্ত ছড়ি ও লজ্জার বোঝাপড়ায় সমবেত সংগীত হল।

লেখক শিক্ষক ও গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE