Advertisement
E-Paper

রাজ্য সরকারই বাংলাকে ‘দ্বিতীয় ভাষা’ তকমা দিচ্ছে!

প্রথমে প্রশাসনের দিকটাই বলি। এর মধ্যে অনেক সরকারি স্কুলে উঁচু ক্লাসে (একাদশ-দ্বাদশ) ইংরেজি মাধ্যম হয়েছে বলে শুনেছি।

পবিত্র সরকার

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৬
সম্মান: পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য মর্যাদা পায় না, বাংলাদেশে কিন্তু অন্য ছবি। ঢাকার ভাষা শহিদ মিনার-এ একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান

সম্মান: পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য মর্যাদা পায় না, বাংলাদেশে কিন্তু অন্য ছবি। ঢাকার ভাষা শহিদ মিনার-এ একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান

কৃষ্ণনগরের সরকারি প্রাথমিক স্কুল ইংরেজি মাধ্যম হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্বিতীয় সম্পাদকীয়, ১ মে, ২০১৭), এবং অন্যান্য দু-একটি স্কুল অনুমোদনের অপেক্ষা পেয়েছে— এত দিন এই সব খবর ছুটকো চরিত্রের বাইরে যায়নি। এ বার স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে সেই আনন্দিত ও প্রতাপশালী ঘোষণাটি নির্গত হল, যার শিরোনাম ‘প্রাথমিকে ইংরেজিতেও পড়াশোনা সরকারি স্কুলে’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭)। এই খবরে নিশ্চয়ই স্বর্গে শঙ্খ আর উলুধ্বনি হয়েছে, আকাশ থেকে দিব্যাঙ্গনারা পুষ্প বর্ষণ করেছে। আর বাঙালির চাইবার কিছু নেই, তার সমস্ত বাসনার সন্তর্পণ ঘটেছে। খুন, ধর্ষণ, পণের জন্য বধূহত্যা বা বধূর প্ররোচিত আত্মহত্যা, ঋণের জন্য চাষির অনুরূপ দুষ্কর্ম, প্রতিবাদীকে মহাসুখে পেটানো, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, রাজনীতিকদের কুৎসিত ভাষাপ্রয়োগ— সব মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেছে, শুধু বাকি আছে বাঙালি সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বাজারে ইলিশ সস্তা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ঘোষণাটা অনিবার্য ছিল। এটা নিয়ে নতুন একটা উৎসব শুরু হতেই পারে। ইংরেজি পৈতা-ধারণের নতুন উপনয়ন।

প্রথমে প্রশাসনের দিকটাই বলি। এর মধ্যে অনেক সরকারি স্কুলে উঁচু ক্লাসে (একাদশ-দ্বাদশ) ইংরেজি মাধ্যম হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু সত্যি সত্যি কি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা সেখানে শুরু হয়েছে? যত দূর খবর পাই— সব বিষয় ইংরেজিতে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট শিক্ষক কোথাও দেওয়া হয়নি। ইংরেজি মাধ্যমের শর্ত হল, প্রতিটি বিষয় ইংরেজিতে পড়ানো হবে (‘বাংলাটা ইংলিশে’ পড়ানো হবে কি না সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি), কিন্তু তার জন্য যথেষ্ট যোগ্য শিক্ষক কি সরকারের হাতে মজুত আছে?

দ্বিতীয়ত, যদি এই অবিশ্বাস্য কথা ধরে নিই যে, ক্লাসে প্রাথমিক স্তরে— যেখানে পশ্চিম বাংলায় মাধ্যমিক পাশ করলেই প্রাথমিকে চাকরি করার যোগ্য হয় সেখানে— ইংরেজি ফটাফট পটাপট বলতে পারে এমন শিক্ষক বা শিক্ষিকার অভাব হবে না, সেখানে ছাত্ররাও কি প্রস্তুত? মা-বাবার অন্ধ উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে, কিন্তু শিশু-মনস্তত্ত্বের দিক থেকে প্রাথমিকেই ইংরেজিতে বিষয়টা পড়ানো শুরু হলে ছাত্র আর ভাষার লড়াই চলবে, ছাত্র আর বিষয়ের লড়াইয়ের সঙ্গে। তাতে কত জন ছাত্র জিতবে আর কত জন হারবে, এ ব্যাপারে মনোবৈজ্ঞানিকেরা কী বলেন তা জেনে শিক্ষিত হতে চাই।

আনন্দবাজার পূর্বোক্ত সম্পাদকীয়তে কিছুটা ইতিহাস তুলেছেন, আমিও একটু ইতিহাস তুলি। সবাই জানেন কি না জানি না, হিমাংশুবিমল মজুমদার কমিটি পঞ্চম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শুরু করার সুপারিশ করে ভারতে বা বাংলায় নতুন বা মৌলিক কিচ্ছু করেননি। তার আগে পর্যন্ত যত সর্বভারতীয় কমিটি বা কমিশন কিংবা তার পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্করণ হয়েছে শিক্ষা সম্বন্ধে, তাতে ওই একই সুপারিশ করা হয়েছে। পবিত্র সরকার কমিটির রিপোর্টে (১৯৯৮) সে সব দেখানো আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সম্বন্ধে কোনও কমিটি বা কমিশনই এ বিষয়ে অন্য রকম কিছু বলেনি। রাধাকৃষ্ণন কমিশন, মুদালিয়র কমিশন, মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন, ইংরেজি শিক্ষকদের সম্মেলন— এমনকী ১৯৬৪-৬৬-র কোঠারি কমিশন পর্যন্ত ওই এক রা তুলেছিল— চেনা ভাষাটায় আগে শেখাও, ইংরেজি বা দ্বিতীয় ভাষা পরে। মজুমদার কমিটি সেই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছিল মাত্র। ‘ইংরেজি বর্জন’ কথাটা কেউ বলেনি, কেউ করার কথা ভাবেনি, এমনকী অতিধিক্কৃত বামফ্রন্ট সরকারও না। ইংরেজি পরে শেখানো হবে— এই ছিল পরিকল্পনা। বামফ্রন্ট এই সর্বভারতীয় নীতিটিকেই রূপ দেবার চেষ্টা করেছিল মাত্র। কিন্তু শহরের বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রবল উচ্চকাঙ্ক্ষা তাকে শান্তি দেয়নি, ভোটে তার প্রতিফলন ঘটতে পারে ভেবে সে আস্তে আস্তে তার নীতি বদলানো শুরু করেছিল। ১৯৯১ সালে অশোক মিত্র কমিশন তাকে ক্লাস সিক্স থেকে ফাইভে নামিয়ে আনল, পবিত্র সরকার কমিটি নামিয় আনল থ্রিতে, পরে রঞ্জুগোপাল মুখোপাধ্যায় কমিটি ক্লাস ওয়ান থেকেই ইংরেজি পড়ানো শুরু করার নির্দেশ দিল। যত দূর মনে হচ্ছে, ২০০২ থেকে সেই স্বর্ণযুগের সূত্রপাত।

কিন্তু এখন একটা ভয়াবহ এবং মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। সবাই সেটা বুঝতে পারছেন কি না জানি না। সম্পাদকীয় এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি, কেবল ‘বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে’ বিষয়টি লক্ষ করেছে। কিন্তু এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার পরিণাম কী, তা বাংলার সংস্কৃতিতে কী সর্বনাশের ইঙ্গিত (এ সব ভাষাপ্রয়োগ আমার অতি-প্রতিক্রিয়া কি না সেটা ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই বলবে) বহন করছে, তা নিয়ে ভাবতে অগ্রসর হয়নি। বাংলার সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ স্বর হিসেবে আনন্দবাজারে-এর এটুকু কর্তব্য ছিল। ইংরেজি মাধ্যম মানে ইংরেজি হবে প্রথম ভাষা, বাংলা (বা অন্যান্য ‘মাতৃভাষা’) হবে দ্বিতীয় ভাষা। এবং বিপুল লজ্জা আর বিস্ময়ের কথা হল, সেটা হতে চলেছে সরকারি অনুমোদনে। কোনও সরকার সেই রাজ্যের বা রাষ্ট্রের ভাষাকে সজ্ঞানে ‘দ্বিতীয়’ ভাষা বলে মার্কা দেগে দিচ্ছে, এ জীবনে এমন দেখব বলে আশা করিনি। নিজেদের ভাষার এমন অপমান বোধহয় একমাত্র বাঙালিরাই করতে পারি, ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া সত্ত্বেও। আমার ধারণা, বামফ্রন্ট আমলে যাঁরা ‘প্রাথমিকে ইংরেজি চাই’ বলে রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁরাও এমনটা ভাবেননি। এটা ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ হল কি না— তা নিয়ে তাঁদের এ বার একটু ভাবতে বলব। কারণ এ লেখা শুধু প্রতিবাদের সুখে লেখা নয়, আতঙ্কিত হয়ে লেখা।

আর দ্বিতীয় ভাষা হওয়া মানেই বাংলা ও অন্যান্য ভাষা ইংরেজির গায়ের জোরের কাছে পিছু হটবে। তা বাঙালি ও অন্যভাষী (সাঁওতালি, নেপালি, হিন্দিভাষী, এমনকী পশ্চিমবঙ্গে ওডিয়া আর তেলুগু মাধ্যমের প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে) কম গুরুত্ব দিয়ে শিখবে, এখনও যেমন দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা শুধু পরীক্ষা পাশ করার জন্যই পড়ে ছেলেমেয়েরা। আলোকিত অভিভাবকেরাও নিশ্চয়ই বলবেন, ‘ও বাংলা-ফাংলা নিয়ে ভাবতে হবে না, ইংরেজিটা শেখ ভাল করে’। ইংরেজি ভাল করে শেখাতে কারও আপত্তি নেই, কিন্তু সেটার জন্য বাংলা বা অন্য ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষায় নামিয়ে আনতেই হবে? শিক্ষাবিদরা কী বলেন? বুদ্ধিজীবীরা কী বলেন? এ বারে তো আমি ভাবছি (আমার ভাবনাটা ভুল সেটা আমাকে বোঝানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক) বাংলা সাহিত্যের সংবাদ-সাময়িকপত্রের পাঠক আস্তে আস্তে কমে যাবে, কালক্রমে বাংলা সাহিত্য পাঠক-অজন্মাতে ভুগবে, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার রায়, শরৎচন্দ্র সব জাদুঘরে কুলুঙ্গিবদ্ধ থাকবেন। আনন্দিত হোন, সেই দিন আগত ওই।

language Bengali West Bengal second language Government
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy