অবহেলায় পড়ে রয়েছে সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত রাজবাড়ির খোসরং আমবাগান সংলগ্ন মাঠ।
১ ৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি। গুজরাতের হরিপুরায় জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনে সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ওই বছর তিনি বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবেও পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বভারতীয় সভাপতি হওয়ার পরে সুভাষ প্রথম যে জেলা পরিদর্শনের কথা চিন্তা করেছিলেন সেটা মেদিনীপুর।
সুভাষের ইচ্ছা অনুসারেই তমলুক মহকুমা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি মহেন্দ্রনাথ মাইতি-সহ অন্য বিপ্লবীদের নেতৃত্বে তমলুক শহরে সুভাষের জনসভার তোড়জোড় শুরু হয়। ১৯৩৮ সালের ১১ এপ্রিল, মঙ্গলবার শহরের রাজ ময়দানে স্থির হয় সভার নির্ঘণ্ট। ব্রিটিশ সরকারের তৎকালীন জেলাশাসক সভা বন্ধে তৎপর হয়ে ওঠেন। রাজ ময়দান খেলাধুলোর জন্য হ্যামিল্টন হাইস্কুলকে দিয়েছিল তমলুক রাজ পরিবার। হ্যামিল্টন হাইস্কুলের পরিচালন কমিটির সম্পাদক তখন শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাবা। মেদিনীপুরের জেলাশাসক হ্যামিল্টন হাইস্কুলের সম্পাদক শরৎচন্দ্রকে চিঠি দিয়ে জানান, রাজ ময়দানে সুভাষচন্দ্রের জনসভা হলে স্কুলের অনুমোদন প্রত্যাহার করা হবে। হুঁশিয়ারির মুখে তমলুক রাজ পরিবারের কর্তা সুরেন্দ্রনারায়ণ রায় শহরের অন্যপ্রান্তে চড়ক মেলার জায়গায় জনসভা করার প্রস্তাব দেন। সেই জায়গার মালিক ছিল সাহা পরিবার। তাদের মদের দোকানের লাইসেন্স ছিল। ফলে মেলার মাছে সুভাষের সভা হলে আবগারি লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দেয় ব্রিটিশ প্রশাসন।
এমন পরিস্থিতিতে তমলুকে সুভাষচন্দ্রের জনসভা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত, কুমারচন্দ্র জানা, রজনীকান্ত প্রামাণিকরা তখন তমলুক রাজবাড়ি চত্বরে সভার আয়োজন করতে রাজপরিবারের কর্তা সুরেন্দ্রনারায়ণের সাহায্য চান। সুরেন্দ্রনারায়ণের ছেলে ষড়েন্দ্রনারায়ণ এবং বীরেন্দ্রনারায়ণের মধ্যস্থতায় রাজবাড়ির খাটপুকুরের উত্তর পাড়ের দিকে খোসরং আমবাগান সংলগ্ন মাঠে সভা আয়োজনের সম্মতি মেলে। প্রয়াত বীরেন্দ্রনারায়ণ রায় সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি চারণায় লিখেছেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় পিতা ঠাকুরের পদসেবা করার সময় আমি তাঁকে খোসরঙের আমবাগানে সুভাষবাবুর জনসভা করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করি। পিতা ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি প্রদান করেন।’ বীরেন্দ্রনারায়ণ আরও লিখেছেন, ‘আমি অজয়দাকে সেই অনুমতির কথা জানিয়ে দিয়ে বলি, আপনারা আমবাগান পরিষ্কার করে সুভাষচন্দ্রর জনসভার ব্যবস্থা করুন। তবে আমাদের একটি শর্ত আছে। সুভাষবাবুকে আমাদের বাড়ির ভিতরে আসতে দিতে হবে। আমরা সেখান থেকে তাঁকে সভাস্থলে নিয়ে যাব। অজয়দা প্রথমে গররাজি হলেও শেষ রাজি হলেন।’’
১১ এপ্রিল সকালে হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে তমলুক রওনা হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। সফরসঙ্গী ছিলেন অধ্যাপক জ্যোতিষ ঘোষ, হেমন্তকুমার রায়, প্রমথনাথ বন্দ্যোয়াপাধ্যায়, রামসুন্দর সিংহ, নিকুঞ্জবিহারী মাইতি, বসন্তকুমার দাস ললিতকুমার সিংহরা। কোলাঘাট স্টেশনে পৌঁছনোর পরেই জেলাবাসীর পক্ষ থেকে আইনসভার সদস্য গোবিন্দ ভৌমিক সুভাষকে অভিনন্দন জানান। ট্রেন পাঁশকুড়া স্টেশনে পৌঁছলে তমলুক মহকুমা কংগ্রেসের কমিটির সম্পাদক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সুভাষকে মাল্যদান করে সংবর্ধনা জানান। পরে গাড়িতে পাঁশকুড়া থেকে পাঁশকুড়ার জোড়াপুকুরে যান সুভাষ। সেখানে ছোট সভা হয়। তারপর গন্তব্য ছিল তমলুক পুরসভার অফিস। পুরভবনে যে চেয়ারে সুভাষচন্দ্র বসেছিলেন সেটি সংরক্ষিত রয়েছে। এখান থেকে পার্বতীপুরে কংগ্রেস নেতা সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ি ‘বৈকুণ্ঠধাম’ হয়ে সকাল ১১ টা নাগাদ গাড়িতেই রাজবাড়ির ফটকে পৌঁছন সুভাষ। ততক্ষণে সেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমেছে। তমলুকের রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণ মালা, ধান, দূর্বা ও চন্দন দিয়ে বরণ করে নেন সুভাষকে।
সুরেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গেই হেঁটেই সভাস্থলে পৌঁছন সুভাষ। তারপর মেদিনীপুর জেলা তথা তমলুক মহকুমাবাসী স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক হয়ে যে ভাবে কৃচ্ছসাধন করছেন, তাঁর প্রশংসা করেন। আর দেশকে পরাধীনতার বেড়ি থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানান। সে দিন সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেত্রী ইন্দুমতী ভট্টাচার্য (স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্যামাদাস ভট্টাচার্যের মা)। সভা শেষে দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেলে তমলুক শহর দেখতে বেরোন সুভাষ। প্রথমেই গিয়েছিলেন বর্গভীমার মন্দিরে। সেখানে পুজো দিয়ে যান রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে। সন্ধেয় তমলুক রাজবাড়ির মন্দিরের আটচালায় বিশিষ্টদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠক করেন সুভাষ। সেই রাতে বৈকুণ্ঠধামের অদূরে তমলুক মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি মহেন্দ্রনাথ মাইতির পাকাবাড়ির তিনতলার ছাদে কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন।
সুভাষের স্মৃতি বিজড়িত খোসরং ময়দান এখন অবহেলায় পড়ে। রাজবাড়ির প্রবেশপথ ও প্রাঙ্গণে সুভাষচন্দ্রের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। যে বৈকুণ্ঠধামে তিনি রাত কাটিয়েছিলেন, সেই বাড়িটিরও সংস্কার হয়েছে। কংগ্রেস নেতা সতীশচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী ইন্দুপ্রভাদেবীর ইচ্ছানুসারে তাঁদের নামাঙ্কিত ট্রাস্ট চালায় দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। দোতলা ওই বাড়ির দোতলার ঘরে রাত কাটিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। সেই ঘরে তাঁর ব্যবহৃত সুদৃশ্য চেয়ার এখনও রক্ষিত আছে। যাঁরা সে দিনের সভার কথা পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছেন, তাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন সুভাষ স্মৃতি। বিপ্লবী মহেন্দ্রনাথ মাইতির পরিবারের উত্তরসূরি কল্লোল মাইতি জানান, যে রাতে বৈকুণ্ঠধামে সুভাষচন্দ্র ছিলেন, সেই রাতে তাঁর জন্য ইন্দুপ্রভাদেবী ৫২ রকমের নিরামিষ পদ রান্না করেছিলেন। বৈকুণ্ঠধামের সামনে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে মহেন্দ্রনাথ ও সতীশচন্দ্রের ছবিও যত্নে রাখা হয়েছে। তমলুক থেকে পরদিন কাঁথির পথে রওনা হয়েছিলেন সুভাষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy