চোখ বন্ধ করলে এখনও দৃশ্যটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে! সবে সকাল হয়েছে। গ্রামের একচালা চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কতই বা বয়স তখন! বছর এগারো-বারো। নিস্তব্ধ চারপাশ। সামনের উঠোনে শিউলি ফুল পড়ে যেন কার্পেট হয়ে রয়েছে। তখনও শিশিরের ভারে টুপটাপ করে ভেজা মাটিতে ফুল ঝরছে। সামনে মণ্ডপে সপরিবার দাঁড়িয়ে দুগ্গা ঠাকুর। সপ্তমীর সকালেও বোধন-সন্ধ্যার ধুনোর গন্ধ লেগে রয়েছে মণ্ডপের আনাচকানাচে। একটু দূরে একটা ছাগল তার ছানাকে নিয়ে ঘুরছে। এ সবের মাঝেই খেয়াল করলাম, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নরম রোদ শিউলির গালিচায় যেন আলপনা আঁকছে!
আমি আজও দেখতে পাই সেই সকাল! যত বার পুজো আসে, তত বার শহুরে ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে এসে পড়া রোদ, ঢাকের বাদ্যি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে। এখন পুজোর আগমন বুঝি টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন, হোয়্যাটসঅ্যাপে পুজো কমিটির মেসেজ দিয়ে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষে পুজোর গন্ধটা নাকে আসত অন্য ভাবে। গ্রামের বাড়ি বলতে বারাসতের কাছে ছোট জাগুলিয়া গ্রাম। এখন অবশ্য গ্রামের বাড়ি নেই, সেই গ্রামও নেই! তবে তখন ছিল। বর্ষায় গ্রামের মাটির রাস্তা পিছল হয়ে থাকত। রাস্তার পাশে জল থইথই নিচু জমি। ওই জলেই তো দেখতে পেতাম পুজোর আকাশ।
সেপ্টেম্বর পড়লেই বর্ষার মেজাজ কমত। রাস্তাঘাট শুকনো হত। কিন্তু নিচু জমিতে জল সরত না। সেই জলে দেখতে পেতাম খলসে, পুঁটি মাছের ঝাঁক সাঁতরে বেড়াচ্ছে। কালো মেঘ সরলেই নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ছায়া পড়ত বর্ষার ওই টলটলে জলে! নীল আকাশ জলে গুলে মাঠটাকে যেন নীল করে দিত। জলা গাছের মাথায় উড়ত জলফড়িংয়ের দল। একটু দূরে ঝাঁকে ঝাঁকে কাশফুল হাওয়ায় মাথা দোলাত। বহু বিস্তৃত সেই মাঠই কিশোরের কল্পনায় নদী, সাগর, বিল হয়ে যেত। জমা জলের গন্ধ বলে দিত, আর বেশি দেরি নেই, পুজো আসছে। পাড়ার মাইকে কিশোরকুমার গাইতেন, ‘‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে..’’।