এখন হইতে শিক্ষকেরা নিজের জেলার বিদ্যালয়েই পড়াইবেন। দীর্ঘ যাতায়াতে, অথবা সপ্তাহান্তে ঘরে ফিরিবার তাড়ায় তাঁহাদের সময় নষ্ট হয়, কাজে ব্যাঘাত ঘটে— শিক্ষকদের এই যুক্তি সরকার গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু অতঃপর ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কী ভাবে রক্ষিত হইবে, তাহা বলে নাই। বুনিয়াদি শিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কী হইবে, তাহা নির্দিষ্ট করিয়াছে শিক্ষার অধিকার আইন। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির অনুপাত স্থির করিয়াছে শিক্ষা দফতরের নীতি। সেই আদর্শ অনুপাতের সহিত মিলাইয়া দেখিলে স্পষ্ট হয়, অনেক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক দিতে সরকার ব্যর্থ। পার্শ্বশিক্ষক কাজ চালাইতেছেন, এক বিষয়ের শিক্ষক একাধিক বিষয় পড়াইতেছেন। বহু বিদ্যালয়ে অঙ্ক কিংবা বিজ্ঞানের যথেষ্ট শিক্ষক নাই বলিয়া উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগই নাই। বিশেষত প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাব প্রায় চিরস্থায়ী। জেলাগুলির অভ্যন্তরেও বৈষম্য স্পষ্ট। শহরাঞ্চলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক, গ্রামীণ এলাকায় যথেষ্ট শিক্ষক নাই। শিক্ষককে নিজগৃহের নিকটবর্তী স্কুলে রাখিবার সিদ্ধান্ত এই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করিবে না কি? নীতি প্রণয়ন সহজ নহে। তাহার রূপায়ণে জড়িত সকলের স্বার্থ অবশ্যই বিবেচনা করিতে হইবে। কিন্তু নীতির প্রধান লক্ষ্য কী, তাহা ভুলিলে চলিবে না। শিক্ষানীতির লক্ষ্য— শিশুর শিক্ষালাভ। একটিও শিশু যেন শিক্ষাবঞ্চিত না থাকিয়া যায়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে শিক্ষানীতিকে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাইয়াছেন, নিজের জেলায় ‘পোস্টিং’-এর বিধি মানিয়া শিক্ষক বণ্টনের রূপরেখা স্থির করিতে বলা হইয়াছে শিক্ষামন্ত্রীকে। প্রশ্ন উঠিবে, রূপরেখা স্থির না করিয়াই কী করিয়া এত বড় সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল? প্রয়োগের পদ্ধতি না ভাবিয়া কেন বদলাইল বিধি? রাজ্য সরকার বর্তমানে রাজ্যস্তরে পরীক্ষা লইয়া মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নির্বাচন করে। শিক্ষকের ঠিকানা সেখানে বিবেচ্য নহে। যে জেলায় যত শিক্ষক প্রয়োজন, তত সংখ্যক শিক্ষকের নিবাস সেই জেলায় না-ই হইতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলার প্রতিটি স্কুলে যথেষ্ট শিক্ষক সরকার নিয়োগ করিবে কী উপায়ে? সরকারের নিকট একটি বিকল্প ইহা হইতে পারে যে অতঃপর কোনও প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় তাঁহার ঠিকানা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হইবে— অর্থাৎ, ভিন্জেলার বা ব্লকের যোগ্যতর প্রার্থী অপেক্ষা স্বজেলা বা ব্লকের তুলনায় অযোগ্য প্রার্থী শিক্ষকতার চাকুরি পাইবেন। তাহাতে শিক্ষকদের সুবিধা হইবে বিলক্ষণ, কিন্তু ছাত্রদের স্বার্থ কতখানি রক্ষা পাইবে, মুখ্যমন্ত্রী ভাবিতে পারেন।
এই ব্যবস্থার অসম্ভাব্যতা যদি রাজনীতিকেরা অনুধাবন করিতে পারেন, তবে আর একটু ভাবিলে তাঁহারা কেন্দ্রায়িত নিয়োগপদ্ধতির অযৌক্তিকতাও বুঝিবেন। স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের কাজটি শিক্ষা দফতর আদৌ কেন করিবে? প্রতিটি স্কুলের পরিচালনা সমিতি আছে। শিক্ষক নিয়োগ তাহার এক্তিয়ারভুক্ত হওয়াই বিধেয়। পার্থবাবু হয়তো যুক্তি দিবেন, তিনি টাকা দেন বলিয়া নিয়োগের লাগামও তাঁহার হাতেই থাকিবে। যুক্তিটি তাহার অন্যান্য অনুরণনের ন্যায় সারবত্তাহীন। শিক্ষকদের বেতন বাবদ টাকা দেওয়া রাজ্য সরকারের কর্তব্য। কোন পদের জন্য কী শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন, শিক্ষা দফতর বড় জোর তাহা স্থির করিতে পারে। কিন্তু, শিক্ষক নিয়োগ করিবে স্কুল। পরীক্ষা লইয়া, ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে, না কি নিতান্ত স্বজনপোষণের পথে হাঁটিয়া, সেই সিদ্ধান্ত স্কুলই লইবে। শিক্ষার গুণগত মানের অবনমন ঘটিলে বাজােরর নিয়মেই সেই স্কুল পিছাইয়া পড়িবে। স্কুলের ফলাফলের উপর তাহার আর্থিক সাহায্য নির্ভর করিতে পারে কি না, শিক্ষামন্ত্রী বরং সেই কথা ভাবিয়া দেখিতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy