Advertisement
E-Paper

একটু সময় হবে, স্যর?

আশ্চর্য ইস্কুলের চেহারাটাও। বীরভূমের কঙ্কালীতলায় দুটো গ্রামের মাঝে, ফাঁকা জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে। ঘরবাড়ির দশা দেখে মনে হয় যেন বর্ডার এলাকা। নিয়ত আক্রান্ত। এক দিদিমণি বললেন, প্রতি দিন তাঁর প্রথম কাজ ভাঙা কাচ ঝাঁট দিয়ে তুলে ফেলা।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০৩

মর্তে যখন খুব আশ্চর্য, অতি মহৎ কিছু হয়, তখন নাকি পুষ্পবৃষ্টি হয়। সত্যি? আশ্বিনের দুপুরে আধা-অন্ধকার এক ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে মনে হল, সত্যি বইকি। মালিনী বাস্কে, দিশা মুর্মু, উমা কর্মকাররা যখন অপরিচিত অনুচ্ছেদ গড়গড় করে পড়ে, তখন জানালা দিয়ে আসা আলোটুকু যেন ফুলের মতো ঝরে পড়ে। হেডমাস্টারমশাই হেসে বললেন, ‘‘যাকে ইচ্ছে ডাকুন না, ওরা সবাই পড়তে-লিখতে পারে।’’

সব পড়ুয়া পড়তে পারে, এমন ইস্কুল গ্রামে আছে? ‘প্রথম’ সংস্থার নমুনা সমীক্ষা বলছে, রাজ্যে অর্ধেক শিশু সরল বাংলা বাক্য পড়তে পারে না, বিয়োগ কষতে পারে না। বীরভূমে দেখা যাচ্ছে, যারা প্রাথমিক পেরিয়ে পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণিতে, তাদেরও তিন জনে এক জন ‘‘বোলপুরে দোলের মেলা, মেলায় অনেক দোকান বসে’’ পড়তে পারছে না। সে জেলায় একশো শতাংশ সাক্ষর স্কুল আশ্চর্য নয়?

আশ্চর্য ইস্কুলের চেহারাটাও। বীরভূমের কঙ্কালীতলায় দুটো গ্রামের মাঝে, ফাঁকা জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে। ঘরবাড়ির দশা দেখে মনে হয় যেন বর্ডার এলাকা। নিয়ত আক্রান্ত। এক দিদিমণি বললেন, প্রতি দিন তাঁর প্রথম কাজ ভাঙা কাচ ঝাঁট দিয়ে তুলে ফেলা। যারা স্কুলের মাঠে বসে মদ-মাদক খায়, তাদের ‘উপহার’। অফিসের দরজায় আঘাতের চিহ্ন। নাকি আলমারির পাল্লা ভাঙা হয়, চেয়ার চুরি হয়। বার বার।

পাঁচিল দেন না কেন? ‘‘কোথায় দেব? চার পাশে এই যে এত জমি দেখছেন, সব তো এই স্কুলেরই।’’ তা হলে এই দশা কেন? ‘‘বুঝে নিন। গ্রামের লোকও ভোরে বা সন্ধ্যায় এই দিকে আসতে চায় না।’’ সত্তর বিঘে জমি যে ইস্কুলের, মাত্র দুটো ঘর নিয়ে জড়সড় হয়ে সে দাঁড়িয়ে।

ঠিক এমনি দশা গরিবের শিশুর। খাতায়-কলমে সে-ই তো রাজা। তার জন্য ছিয়াশি হাজার ইস্কুল, সাড়ে তিন লক্ষ শিক্ষক। সরকার প্রাথমিকের শিশুর জন্য বছরে এগারো হাজার টাকা খরচ করে। বাবা-মা টিউটরকে দেন আঠারোশো থেকে আড়াই হাজার। তবু শিশু শিক্ষার কাঙাল। ইস্কুলে দখল হয় জমি, ক্লাসে দখল হয় শিক্ষকের সময়।

এক শিক্ষক বললেন, ‘‘ভাল ঘরের ছেলে যেটা দশ মিনিটে বুঝে যায়, গরিবের ছেলের তা বুঝতে দু’ঘণ্টা লাগে। এত সময় কে দেবে?’’ কিন্তু তেমন ছেলেমেয়েই যে বেশি! পিছিয়ে-প়ড়াদের গ্রুপ তৈরি করে পড়াতে বলা হয় না ট্রেনিংয়ে? ‘‘পড়াই তো গ্রুপ করে। কিন্তু ভাল ছেলেরা বাড়িতে বলে দেবে, স্যর নিজে পড়াচ্ছে না। আমরা খারাপ হয়ে যাব। সিলেবাস শেষ হচ্ছে না কেন, কৈফিয়ত দিতে হবে।’’

কী করেন তা হলে? ‘‘কী করব? গরিব বাবা-মায়েদের ডেকে বলি, ছেলে ভাল পারছে না।’’ ওঁরা কী বলেন? ‘‘বলেন, একটা টিউশন তো দিয়েছি, তা হলে আর একটা দিতে হবে।’’ মির্জাপুরের গীতা বর্মণ, চৈতালী বর্মণ নিজেরা ইস্কুলে যাননি, মেয়ের কোন ক্লাস তা-ও ঠিক জানেন না। কিন্তু ভাল পড়াশোনার জন্য কী করা দরকার, প্রশ্ন শুনে দু’জনেই বললেন, ভাল মাস্টার দেওয়া দরকার।

সমীক্ষা বলছে, গ্রামের ৯৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে প্রাইভেট টিউশনে যায়। কিন্তু ১৬ শতাংশ অক্ষরও চেনে না। কেন? এক প্রাইভেট টিউটর বললেন, ‘‘অনেকে পড়ে। কে কতটা বুঝল বোঝা সম্ভব নয়।’’ পিছিয়ে-পড়ারা ক্লাসেও চুপ করে থাকে, টিউশনেও। টিউশন এখন স্কুলের দ্বিতীয় সংস্করণ। স্কুলে চার ঘণ্টায় যা হয়, আরও দু’ঘণ্টা তা-ই হয় কোচিং-এ। মির্জাপুরের মামণি বর্মণের ক্ষোভ, ‘‘আমাদের ছেলেদের এক পাশে বসিয়ে রাখে, দেখায় না। যাদের অবস্থা ভাল, তাদের দেখায়।’’

শিক্ষক মনে করেন, সময় দেওয়া চাই বাবা-মায়ের। দেবগ্রামের এক সরকারি স্কুলশিক্ষক বললেন, ‘‘আমার চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসে আটচল্লিশ জন প়়ড়ে। টেনেটুনে দশ জন ঠিকঠাক শিখছে। কারণ এদের বাবা-মায়েরা সচেতন। ছেলেমেয়েকে টাইম দেন।’’ কেন? ইস্কুলে চার ঘণ্টা, টিউশনে দু’ঘণ্টা। তিন-চার বছর ধরে সপ্তাহে ছ’দিন, ছ’ঘণ্টা পড়ে গরিব শিশু। লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে শেখার জন্য আরও সময় দেওয়া চাই?

যা চাই, শিক্ষকদের মতে তা হল বাড়িতে বাবা-মায়ের সময়, আর ইস্কুলে পাশ-ফেল। না-শিখেই যে ক্লাসে উঠে যাচ্ছে, সে পড়বে কেন? ভয় দেখাতে মারধর, বকুনি নিষিদ্ধ হয়েছে। এক ক্লাসে দু’বছর রেখে দিলে শিক্ষককেই জবাব দিতে হয়, তা হলে আপনি কী পড়ালেন? ফেল করার ভয় থাকলে বাচ্চারা পড়বে। হ্যাঁ, স্কুলছুট বেড়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু যারা স্কুলে থাকবে, তারা শিখবে।

তারা ক’জন? যদি পরীক্ষা ঠিক মতো নেওয়া হয়, কেমন হবে পাশ-ফেলের চেহারা? ‘‘তা ধরুন, ফর্টি পার্সেন্ট।’’ এত জন ফেল? ‘‘না না, ফর্টি পার্সেন্ট পাশ করবে। ষাট জনই ফেল।’’ সর্বনাশ! পাশ-ফেল চালু হলে কী হবে তা হলে? যে গ্রামে ইস্কুল, তারই বাসিন্দা প্রধান শিক্ষক। বললেন, ‘‘গরিবের ছেলের কী হবে যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমিও বলতে পারব না।’’

আর এক গ্রামের প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘‘ছেলে সব এক। আমরা ক্যাপচার করতে পারছি না।’’ কেন? ‘‘আগে মেয়ে টিচারদের দুর্নাম ছিল, ক্লাসে সোয়েটার বোনে। এখন পুরুষ-মেয়ে, সব টিচার ক্লাসে এসে মোবাইল ঘাঁটে। সরকার বলছে, তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে যারা পারল না, তাদের নিয়ে আলাদা করে বসতে হবে। করবে কে?’’ কিন্তু মূল্যায়নের নম্বর দেখে বাবা-মা ছুটে আসেন না? হাসলেন ভদ্রলোক। ‘‘চার মাস অন্তর যে পরীক্ষা, তার খাতার সঙ্গে মার্কশিটের নম্বর মিলিয়ে দেখুন। কোনও মিল পাবেন না।’’

বাবা-মা কিন্তু নম্বরকে গুরুত্ব দেন। সমীক্ষার এক কর্মীর কথায়, ‘‘আমরা যখন দেখিয়ে দিই, বাচ্চা পড়তে পারছে না, তখন বাবারা বলেন— এত মাস্টার দিলাম তবু পারলি না? আজ তোর হচ্ছে। আর মায়েরা বলেন— ও তো ইস্কুলে পারে, এখন লজ্জা পাচ্ছে।’’

এই হল ছক। উপরওলার কাছে জবাবদিহি এড়াতে, টিউশন বাঁচাতে, শিক্ষক বেশি নম্বর দিয়ে শিশুর অশিক্ষা আড়াল করেন। দরিদ্র বাবা-মা সে ফাঁকি ধরতে পারেন না। শিক্ষার যা প্রধান শর্ত, শিক্ষকের সময়, তা দখল করে নেয় বিত্তবানের শিশুরা। তাদের বাবা-মায়েরা সজাগ ক্রেতা, শিক্ষক কতটুকু কী দিচ্ছেন তা ওজন করে নিচ্ছেন। গরিব বাবা-মায়ের সে ক্ষমতা নেই। তাঁরা ধরে নিচ্ছেন, স্কুলে যখন যাচ্ছে, টিউশনের টাকা যখন গুনছি, তখন নিশ্চয়ই শিখছে। ছেলে কিন্তু ছকটা বোঝে। মা পড়তে বললে বলে, ‘‘দেখে নিয়ো, পাশ করব।’’

খেতমজুর খেত-মালিককে বলতে পারেন না, ‘‘মজুরি দিলে কী হবে, খেত আপনার। ধান আপনাকেই কাটতে হবে।’’ মজুর বলতে পারেন না মালিককে, ‘‘আপনার কারখানা, আপনি লেবার দিন।’’ কিন্তু শিক্ষক স্বচ্ছন্দে বলেন, ‘‘ছেলে আপনার, আপনাকেই পড়াতে হবে।’’ আর সত্যিই সেই অনুজ্ঞায় শিক্ষা চলছে। সমীক্ষা-কর্মীদের অভিজ্ঞতা, যে মায়ের শিক্ষা কম, তার শিশুরও শিক্ষা কম থেকে যাচ্ছে। গ্রামের ইস্কুলে কত শিক্ষক, টিউটর কত টাকা নেন, কিছুই আসে যায় না।

স্কুল আর টিউশন, দুটোতেই গরিবের সময়-বঞ্চনা চলতে থাকে। পরিণাম শিক্ষা-বঞ্চনা। শিক্ষকের সময় নেই, তাই গরিব শিশুর দিন-মাস-বছর নষ্ট হয়। উপেক্ষার ভাঙা কাচে বিদ্ধ হয় শিশুমন।

বাবা-মা বলেন, দোষ তাঁদেরই। ভাল টিউটর দিতে পারেননি। দোষ সন্তানেরও। দেবগ্রামের রাধারানি বাগদি বলছিলেন, ‘‘আমার ছেলেটা কাঁচা, দুর্বল। ক্লাস নাইনে ফেল করে আর যায় না। মাস্টার বলেছে, বড় চঞ্চল।’’ মুখ ঘুরিয়ে ফিক করে হাসে ক্লাস থ্রি। খাটো চুল, তরতরে মুখ। কী নাম রে তোর? নবনীতা। লেখ দেখি? লিখল, ‘নবনিতা ডোম।’ কে পড়ায়? পাশে-বসা বধূ ঘোমটা আর একটু টেনে দিলেন। উনি মাধ্যমিক ফেল। মাসে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে উনিই পড়ান।

বিদায়ের সময় পাতলা হাতটা বাড়িয়ে দেয় বালিকা। ওই হাতে সাহিত্য অকাদেমি, ভাটনগর, এশিয়াড গোল্ড, ওই হাতে নাচের মুদ্রা, সার্জেনের স্ক্যালপেল। শুধু যদি ওই হাতে দেওয়া যেত সেই দুষ্প্রাপ্য সম্পদ, শিক্ষিত মানুষের সময়। কী আশ্চর্য সব কাণ্ডই না হত।

Time Teacher Student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy