Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
দেশ আমাদের, তেরঙা আমাদের, জাতীয়তা আমাদের

দুয়ার আজি খুলে গেছে

এ নিছক প্রতিবাদ নয়। এই আদিগন্ত প্রতিবাদী প্রত্যয়ের গভীরে আছে এক সুতীব্র দাবির অঙ্গীকার। নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবি। সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাঁধ মিলিয়ে মন মিলিয়ে বাঁচার দাবি। স্বাধীনতার দাবি। ‘আজাদি’ কথাটা এক অনন্য শক্তি নিয়ে উঠে এল দেশ জুড়ে।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

সিনেমা হলে নানা ধরনের বিরক্তির কারণ ঘটে। সহনাগরিকদের অদম্য গুঞ্জন, মোবাইলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড, পপকর্নের মর্মর, ভেলপুরির সুরভি, বিজ্ঞাপনের অনন্ত অভিযান, এবং ইদানীং বাধ্যতামূলক জাতীয় সঙ্গীত। সে দিন, এই শনিবারেও, পর্দায় ন্যাশনাল অ্যান্থেমের জন্য উঠে দাঁড়ানোর বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের নির্দেশ ভেসে উঠতেই মনে বাধ্যতামূলক বিরক্তির আবির্ভাব ঘটল। উঠে দাঁড়ালাম। শুরু হল গান, পর্দা জুড়ে আন্দোলিত হল তেরঙা নিশান।

এবং বিরক্তি অন্তর্হিত হল। বেশ লাগল বরং। সামনের সারিতে দাঁড়ানো বালক যখন ‘পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা’ বলে ডাক ছেড়ে গাইতে শুরু করল, তখন নিজের অজান্তেই গুনগুন করেও নিলাম একটুখানি, ও-গানের সুরের তো সত্যিই তুলনা নেই— শচীন দেব বর্মণ নাকি লোভে পড়ে ওই পঞ্জাব সিন্ধুর সুরটা তুলে নিয়েই টুক করে ‘হমনে তো জব কলিয়াঁ মাঙ্গী’তে বসিয়ে দিয়েছিলেন!

বেশ করেছিলেন।

প্রথমটা নিজেই একটু অবাক হয়েছিলাম, হলটা কী? বুঝতে বিশেষ সময় লাগল না। টের পেলাম, গত একটা সপ্তাহে ভারতে, আমার ভারতে একটা কিছু ঘটেছে। কেবল বাইরে নয়, ভিতরেও। ওই পতাকা, ওই গান— গত কয়েক দিনে ওদের একটা অন্য মানে তৈরি হয়েছে। তৈরি করেছি আমরা। তৈরি করেছে আমার ভারত। নতুন ভারত বলে তাকে দূরে সরিয়ে রেখে দূর থেকে দেখার কোনও কারণ নেই। সে আমারই দেশ। আমাদের দেশ। দেশের ভিতরেই ছিল সে, আছে, এবং থাকবে। অনেক দিন ধরে অনেক মার খেতে খেতে, অনেক ভয় পেতে পেতে সেই দেশ শেষ পর্যন্ত গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দেশ জুড়ে এখানে ওখানে সেখানে প্রতিবাদী নাগরিকের সংগঠিত মিছিলের হাতে হাতে উড়েছে জাতীয় পতাকা, সে যেন আমাদের চরম হাতিয়ার। দিনের পর দিন সংহতির ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা অগণন মানুষের মিছিলের মাথার ওপরে হাত থেকে হাতে প্রসারিত হয়েছে জাতীয় পতাকা, সে যেন আমাদের মাথার ওপরে পরম আশ্রয়। জনগণমন এখন আমাদের স্লোগান, তেরঙার আন্দোলন এখন আমাদের আন্দোলন। এই পরিবর্তন এসেছে আমাদের অবাক করে দিয়ে। ম্যাজিকের মতো। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে ম্যাজিক দেখেছি। আমাদেরই ম্যাজিক।

প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিক্ষোভ, মিছিল— এ-সব আমাদের অচেনা নয়। এমনকি এই ছ’বছরের তমসাপর্বেও সে-সব পুরোপুরি দমিয়ে রাখা যায়নি। কিন্তু গত এক সপ্তাহে যা ঘটেছে, ঘটে চলেছে, তার একেবারে একটা ভিন্ন মাত্রা দেখতে দেখতে স্পষ্ট হয়ে উঠল। নানা দিক থেকে নানা কণ্ঠে নানা ভাবে একটাই কথা উঠে এল: ভয় ভেঙে গেছে। এই সমস্বর আকাশ থেকে পড়তে পারে না, এ একেবারে সমাজের বুকের ভিতরে জাগ্রত প্রত্যয়ের ঘোষণা। দেশের নানান প্রান্তে, এবং খাস রাজধানীর বুকে, হাজার হাজার তরুণতরুণীর মুখের কথায়, চোখের দৃষ্টিতে, শরীরের ভাষায় সেই প্রত্যয় নির্ভুল দেখেছি আমরা, বেধড়ক-মার-খাওয়া, মাটিতে-লুটিয়ে-পড়া, রক্ত-ভেসে-যাওয়া মুখেচোখেও তা হারিয়ে যায়নি, মরে যায়নি।

না, এ নিছক প্রতিবাদ নয়। এই আদিগন্ত প্রতিবাদী প্রত্যয়ের গভীরে আছে এক সুতীব্র দাবির অঙ্গীকার। নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবি। সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাঁধ মিলিয়ে মন মিলিয়ে বাঁচার দাবি। স্বাধীনতার দাবি। ‘আজাদি’ কথাটা এক অনন্য শক্তি নিয়ে উঠে এল দেশ জুড়ে। সেই শক্তিই জাতীয় পতাকাকে নতুন করে চিনতে শেখাল, জাতীয় সঙ্গীতকে নতুন করে শুনতে শেখাল।

এবং জানিয়ে দিল, জাতীয়তাবাদের আসল মানেটা কী। যাঁরা এখন দেশ শাসন করছেন তাঁরা বরাবর ওই শব্দটিকে কব্জি ডুবিয়ে ভোগ করে এবং নিজস্ব পিত্তরসের সাহায্যে সেটি পরিপাক করে দেশবাসীকে পরিবেশন করে এসেছেন। দেশবাসীর এক বড় অংশ সেই ভয়ানক গরলকেই প্রকৃত পানীয় জ্ঞানে সেবন করেছেন, করে চলেছেন। নেশা ক্রমশ জমেছে, নেশার নিয়মে। নেশার কারবারিরা তার ফসল তুলেছেন, কারবারের নিয়মেই। যারা নেশার ছলনায় ভুলিনি, বিষকে অমৃত বলে ভুল করিনি, তারা প্রতিবাদ করেছি, এই বিকৃত, বিদ্বেষী, ঘর-পোড়ানো, দেশ-জ্বালানো অতিজাতীয়তাবাদের নিন্দায় মুখর হয়েছি, কিন্তু নেশা ছাড়ানো কি আর সহজ কাজ? ক্রমশ হতাশা জমেছে, আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছি, ‘দেশটা মনে হয় হাতের বাইরেই চলে গেল।’ মে ২০১৯ থেকে ক্রমশই আমাদের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়েছে, সর্বনাশের ষোলো কলা পূর্ণ হওয়ার প্রহর গুনেছি।

অবশেষে বছরের অন্তিম পক্ষটিতে পৌঁছে আমরা সটান উঠে দাঁড়িয়ে বলতে পারলাম: ‘নো পাসারান’— চলবে না। এই নয় যে, বলতে পারলাম মানেই কথাটা বলা হয়ে গেল, বলাটা শেষ হয়ে গেল। একেবারেই নয় তা। সামনে এখনও কঠিন লড়াই, যে লড়াই— কোনও সন্দেহ নেই— অচিরেই কঠিনতর হয়ে উঠবে, কারণ আমাদের এই সংহতি ভেঙে দেওয়ার জন্যে চতুর্দিক থেকে বহুমুখী আক্রমণ শুরু হবে। বস্তুত, শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিনে যা যা ঘটেছে, সবটাকে একটা ‘মুসলিম জাগরণ’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য জোরদার প্রচার জারি হয়ে গেছে। রাষ্ট্রশক্তি এবং তার পোষা অথবা অনুগত ঠেঙাড়েরা পোশাক এবং অন্যান্য লক্ষণ দিয়ে তার আক্রমণের লক্ষ্য বেছে নিয়ে যুগপৎ ভীতিপ্রদর্শন এবং মেরুকরণের চেনা ছক প্রয়োগ করেছে প্রবল উদ্যমে। এই জোশ উত্তরোত্তর প্রবলতর হবে। তাই বলছিলাম, সামনে দুস্তর পারাবার।

সেই কারণেই ভয়-ভাঙা এই না’খানি কোনও মতেই হাতছাড়া করা চলবে না। একটা ব্যাপারে তিলমাত্র সন্দেহ নেই। দেশ, জাতি, জাতীয়তাবাদ— এই লব্জগুলি বারংবার আওড়াতে আওড়াতে শাসকরা নিজেদের চার পাশে যে মেকি নৈতিকতার বাতাবরণ তৈরি করে, সেই মিথ্যে দেশপ্রেমকে তারা বহু মানুষের চোখে সত্যি বলে প্রতিপন্ন করতে পেরেছিল। তার অভিঘাতে প্রতিবাদীরাও দেশদ্রোহী সাব্যস্ত হওয়ার ভয়ে যেন অনেকটাই গুটিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ছলনার জালটি ছিঁড়ে গেছে, ভেঙে গেছে ওঁদের বানানো মিথ্যে-জাতীয়তার প্রতিমা। সেই বিচূর্ণ প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পেরেছি, ‘কিসের জাতীয়তাবাদ? দেশ আমাদের, জমি আমাদের, তেরঙা আমাদের, জনগণমন আমাদের।’ আমরা আমাদের জাতীয়তার ওপর আমাদের নৈতিক অধিকার দাবি করেছি, করছি, করব। সে ওই অশিক্ষিত, কাঁচা, স্থূল, বিষাক্ত জাতীয়তা নয়, সেই বহুধারাধারিণী ঐশ্বর্যময়ী সর্বমঙ্গলা জাতীয়তা সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে বেঁচেছে, বাঁচছে, বাঁচবে। হ্যাঁ, আমাদের এই একান্নবর্তী সংসারে নিশ্চয়ই অশান্তি হবে, ঝগড়াঝাঁটি হবে, সে আমরা বুঝে নেব, আমাদের জাতীয় পতাকার আশ্রয়ে বসেই বুঝে নেব। সিনেমা দেখতে গেলেই জাতীয় সঙ্গীত শুনতে হবে— এই জবরদস্তিতে এর পরেও বিরক্ত হব, কিন্তু সেটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া। তুমি কে? তোমরা কারা?

আর হ্যাঁ, এর পরেও যদি কথা বলতে আসো, বিদ্বেষের কথা, ভাগাভাগির কথা, অত্যাচারিত শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার নাম করে তার ধর্মপরিচয় খুঁড়ে ভয় দেখানোর কথা, তবে মুখের ওপর শুনিয়ে দেব জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যে দীর্ঘ কবিতার প্রথম স্তবকটুকু আমরা গাই, তারই পরের দু’টি পঙ্‌ক্তি: ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী/ হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী।’ তোমাদের কঠিন, বধির, নির্বোধ হৃদয় এর মর্ম বুঝবে, সে আশা করি না। কিন্তু আমরা বুঝি। ওটাই আমাদের জাতীয়তাবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nationalism India Today BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE