Advertisement
E-Paper

অন্য ভারত

‘সদ্ভাব’ শব্দটি মন্দ বলা চলে না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বা সামাজিক সাম্য ইত্যাদিতে যে গভীর রাজনৈতিক দর্শন নিহিত, তাহার ছায়ামাত্র এই শব্দ বা তাহার অন্তর্লীন ধারণাটিতে মিলিবে না।

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০

উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের পঁচাত্তরতম বর্ষ উদ্‌যাপনটি ভারতীয় সংসদে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা সঞ্চার করিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মূল স্লোগানটিকে যে ভাবে পুনর্ব্যবহার করিলেন, তাহা অর্থহীন ও বিপজ্জনক। ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ স্লোগানটির যে গভীর তাৎপর্য, তাহা এক লহমায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখের ‘করেঙ্গে অর করকে রহেঙ্গে’ শব্দবন্ধে অর্থহীনতায় পর্যবসিত হইল, কেননা ইহা ব্যক্তিগত বা দলগত রাজনীতির উচ্চারণ। ইতিহাস উদ্‌যাপন করিতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসের অমর্যাদা করিলেন। ‘করিব এবং করিতে থাকিব’, এই বাক্যে গভীরতা তো নাই-ই, কোনও রাজনৈতিক আদর্শও নাই। দেশের স্বাধীনতার জন্য আপ্রাণ লড়াই আর নিজের কার্য সিদ্ধির জন্য লাগাতার লড়াই-এর মধ্যে সম্পর্ক খোঁজা বাতুলতা। যেন তেন প্রকারেণ এই দুই ধারণার মধ্যে সমতা রচনার চেষ্টায় বরং এক রকমের চালাকির আঁচ পাওয়া সম্ভব। অতি দুর্ভাগ্যক্রমে সংসদে সে দিন ওই চালাকিটিই বার বার দেখা গেল। কেবল এই বাক্যটি লইয়া নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও। বিজেপি-শাসিত লোকসভার সে দিনকার গৃহীত প্রস্তাবটিতে যে ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সাম্য ইত্যাদি সাংবিধানিক শব্দগুলিকে এড়াইয়া ‘সদ্ভাব’ ব্যবহৃত হইল, তাহা বুঝাইয়া দিল, মোদী সরকার জানিয়া শুনিয়া সুস্থ সাংবিধানিক আদর্শ হইতে সরিয়া একটি অন্য রাজনীতি তৈরি করিতেছে। এবং একটি অন্য ভারত।

‘সদ্ভাব’ শব্দটি মন্দ বলা চলে না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বা সামাজিক সাম্য ইত্যাদিতে যে গভীর রাজনৈতিক দর্শন নিহিত, তাহার ছায়ামাত্র এই শব্দ বা তাহার অন্তর্লীন ধারণাটিতে মিলিবে না। ভারতের মতো বহুধর্মবর্ণভাষাসংস্কৃতিবিশিষ্ট দেশে ‘সদ্ভাব’ তাই উত্তম জিনিস হইতে পারে, কিন্তু সেটিই অন্তিম লক্ষ্য হইতে পারে না। সকল নাগরিকের প্রতি নিরপেক্ষতার যে অঙ্গীকার, তাহার পাশ কাটাইয়া নেহাত সদ্ভাব-এর কথা বলিলে সামাজিক বহুত্বকে মর্যাদাদানের চিড়া ভিজে না। একই ভাবে অর্থনৈতিক লক্ষ্য হিসাবে যখন শোনা গেল, দারিদ্র দূরীকরণ এবং দুর্নীতি রোধের কথা, খেয়াল না করিয়া উপায় রহিল না যে এই দুইটি লক্ষ্য যতই সুখশ্রাব্য হউক, ইহাদের মধ্যে কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিন্দুমাত্র অঙ্গীকার নাই, কোনও কালে ছিল না। বাস্তবিক, দারিদ্র দূরীকরণ ও দুর্নীতি রোধের বাণী কপচাইয়াই তো বিশ্বের সমস্ত কর্তৃত্ববাদী অগণতন্ত্র চির কাল কাজ গুছাইয়া লইয়াছে, ফ্যাসিবাদী ইউরোপ হইতে ‘সমাজতান্ত্রিক’ চিন, কিংবা জরুরি অবস্থার ভারতও। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও বহুত্ববাদের মর্যাদার সহিত সামাজিক উন্নয়নের সংযোগের দিকে যে মোদীর সামান্যতম উৎসাহও নাই, ইহা অপেক্ষা বড় প্রমাণ কোথায়।

বিরোধী সাংসদরা এই চালাকির রাজনীতি ধরিতে ভুল করেন নাই। সাংসদ সুগত বসু তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ স্মিত সমালোচনায় ধরাইয়া দিয়াছেন যে প্রধানমন্ত্রীর ‘পরিবর্তিত’ ভারত সম্ভবত এই নেতি-অর্থেই পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করিতেছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, উপ-রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রপতি সকলেই একেবারে এক সুরে গাহিতে প্রস্তুত, ভারতীয় সংবিধানের নীতিগুলি হইতে সহর্ষে সরিয়া যাইতে প্রস্তুত। কোনও বহুত্ব বা বিতর্ক বা সমালোচনার জায়গা না রাখিয়া এই নূতন ভারত এক ছাঁচে গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগুরুবাদ রচনা করিতে প্রবৃত্ত, বিরোধিতার স্বরকে চাপিয়া মারিয়া ফেলিতে ইচ্ছুক। গত তিন বৎসরের অভিজ্ঞতার পর ইহা ঠিক কোনও নূতন কথা নয়। কিন্তু কী ভাবে ইতিহাসের সকল মুহূর্তের খাঁজে খাঁজে এই নূতন ভারতের পরিবর্তিত লক্ষ্যগুলিকে গুঁজিয়া দিবার সচেতন প্রয়াস চলিতেছে, গণতন্ত্রের গোটা পরিসরটিকে এই সংকীর্ণ অসহিষ্ণু দলতন্ত্র কী ভাবে ক্রমশ গ্রাস করিতেছে, নয় অগস্টের সংসদ তাহা আবার বুঝাইয়া দিল।

Narendra modi Prime Minister India Parliamant Quit India 1942 Diamond jubilee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy