Advertisement
১১ মে ২০২৪
East Bengal

মাটি আর ফুটবল

ইস্টবেঙ্গলের জন্মলগ্ন থেকেই তাদের সঙ্গে মোহনবাগানের চিরশত্রুতা, যার বীজ উপ্ত চিরকালীন বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্বে। তবে দুই ক্লাবের সমর্থকদেরই বুকে আবেগটা আছে, তাই ঝগড়াও আছে। স্বামী-স্ত্রীর নিত্য ঝগড়ার মতো। কিন্তু সময়টাই যে বড় গোলমেলে, তাই শব্দ ব্যবহারেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। লিখছেন সৌম্য মল্লিকময়দানে দুই দলের সমর্থকদের একে অপরকে বিভিন্ন ভাবে বিদ্রুপ করার চল বহু যুগ ধরেই চলে আসছে। সেটা কখনও শালীন, কখনও আবার শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়।

—ফাইল ছবি

—ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:৪৪
Share: Save:

সালটা ২০১৫। ভারত ও বাংলার মানুষ প্রথম দেখল একটি ময়দানি কেরামতি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডার্বি ম্যাচের দিন একটি নতুন বস্তু ভারতীয় ফুটবলে আবিভূর্ত হল— ‘টিফো’। সেই টিফোতে লেখা ছিল, ‘চা চিনি দুধে...’। কথাটা এমনিতে বড্ড সাদামাটা হলেও যাঁরা নিয়মিত ময়দানে যান, তাঁদের কাছে বড্ড চেনা এবং দুই দলের সমর্থকদের কাছেই অশালীন সম্বোধন।

ময়দানে দুই দলের সমর্থকদের একে অপরকে বিভিন্ন ভাবে বিদ্রুপ করার চল বহু যুগ ধরেই চলে আসছে। সেটা কখনও শালীন, কখনও আবার শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়। ২০ জানুয়ারির ডার্বিতেও দেখা গিয়েছে টিফোর ঝলক। সেটা দু’পক্ষ থেকেই। মোহনবাগান এনেছিল ১৯১১ স্মরণে ইংরেজকে হারানোর দৃশ্য। ইস্টবেঙ্গল বানিয়েছিল একটু অন্য রকম।

ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে শুরুতেই দেখা যায় একটি টিফো, সেখানে নারায়ণ সান্যালের ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-এর বাঁটুলকে হাড়-জ্বালানে বাচ্চু-বিচ্ছু খোঁচা দিচ্ছে— ‘কী রে বাঙাল, এনআরসি আসছে’, ‘যা পালা’। পরে একটি বিরাট লম্বাটে টিফো নীচে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে লেখা— ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’। আর এখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। কারণ, এই টিফো বর্তমানে সর্বাধিক চর্চিত রাজনৈতিক বিষয়কে সামনে রেখে বানানো। ‘কাগজ দেখাব না’— এই বার্তাই যেন ধ্বনিত হয়েছে।

অনমিত্রের লেখা একটি কবিতা থেকে লাইনটি নেওয়া— ‘‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়/ সকালবেলার আলোয় আছে আমার পরিচয়/ কাগজ চাওয়া তাদের সাজে/ হোঁৎকা যেসব দাঙ্গাবাজে/ দেশের লোকের মাথায় ঢোকায় দেশ হারানোর ভয়’’।

খেলার মাঠে এই ধরনের রাজনৈতিক তরজা কতখানি প্রাসঙ্গিক, তা নিশ্চিত ভাবেই তর্কের বিষয়। খেলার মাঠ এমন একটা তীর্থ যেখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ, রং সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফুটবলপ্রেমীদের যাঁর যা-ই রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকুক, তা সরিয়ে রেখেই প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটান। রোনাল্ডো কোন দেশের প্লেয়ার তা একবাক্যে বলে দেবেন প্রায় সকলেই, কিন্তু এর পর সেই দেশের প্রেসিডেন্টের নাম জিজ্ঞাসা করলে মাথা চুলকোবেন। এটাই ফুটবল। ভুলে গেলে চলবে না যুদ্ধটা কিন্তু ৯০ মিনিটের। রাজনৈতিক তরজার নয়।

কিন্তু পাশাপাশি এ-ও ঠিক যে, ফুটবল মাঠে যাঁরা আসছেন, তাঁরা তো নিরালম্ব বায়ুভূত নন। তাঁরাও খবরের কাগজ পড়ছেন, টিভি দেখছেন, পাড়ার মোড়ে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তর্কে জড়াচ্ছেন। ফলে বাঙালির একটা বড় অংশের মন-মগজ ছেয়ে যখন বিশেষ একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন তার প্রতিক্রিয়াও মাঠে এসে পড়তে পারে।

স্বাভাবিক বুদ্ধি অন্তত তা-ই বলে। যাঁদের শিকড় ওই বঙ্গে, এই টিফোয় তাঁরা তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এবং সংবাদমাধ্যম ভেসে গিয়েছে। দেশের অন্তত ৩০টি কাগজে টিফোর খবর ও ছবি ছাপা হয়েছে। বিশুদ্ধ ফুটবল আবেগের যুক্তি দিয়ে একেই বা উড়িয়ে দিই কী করে?

ইস্টবেঙ্গলের জন্মলগ্ন থেকেই তাদের সঙ্গে মোহনবাগানের চিরশত্রুতা, যার বীজ উপ্ত চিরকালীন বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্বে। তাই তো ডার্বির এত ঝাঁঝ, এত মজা! ঘটিরা যেমন চিরকাল বাঙাল বাহিনীকে ‘কাঁটাতার’ বা ‘খুঁটি পোঁতা কাঙাল’-এর মতো বাছাই সম্বোধনে খোঁটা দিয়ে গিয়েছে, উল্টো শিবির থেকেও উড়ে এসেছে ‘ফুটো ঘটি’র মতো সুভাষণী। লেখার অযোগ্য ময়দানি গালিগালাজ তো আছেই। এখন দুই দলেই বাঙাল-ঘটি দূরে থাক, ক’টা বাঙালি আছে তা এক হাতে গুণে ফেলা যাবে। কিন্তু সমর্থকদের বুকে আবেগটা আছে, তাই ঝগড়াও আছে। স্বামী-স্ত্রীর নিত্য ঝগড়ার মতো। ঝগড়া না হলে সব পানসে।

কিন্তু সময়টা যে গোলমেলে তা-ও মাথায় রাখতে হবে। এত দিন একে অন্যকে আক্রমণ শানাতে বেশি কিছু না-ভেবেই আমরা যে সব বিশেষণ ব্যবহার করে এসেছি, এখন কিন্তু আর তেমনটা চলবে না। ‘কাঁটাতার’ বলার আগে ভেবে নিতে হবে, অন্য কোনও মানে দাঁড়িয়ে যাবে না তো? শুনেছি, যুবভারতীর দিকে যাওয়া কোনও-কোনও মোহনবাগানি ট্রাক থেকে ‘এনআরসি এনআরসি’ ধ্বনি তোলা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার তরজায় লেখা হয়েছে, ‘এ বার তো তোদের কাঁটাতারের ও পারে গিয়ে খেলতে হবে!’ তারই হয়তো প্রতিক্রিয়া হয়েছে ইস্টবেঙ্গলের ওই টিফোয়, যা আবার নয়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সতর্ক আমাদের থাকতেই হবে। দুই পক্ষকেই। হয়তো ভেবে-চিন্তে কারও ক্ষতি করার জন্য কেউ কিছু করছি না। কিন্তু আমাদের ফুটবল আবেগ, নিজস্ব ঝগড়া কিছু রাজনীতির কারবারির হাতে আয়ুধ হয়ে উঠবে, সেটাও যে কাম্য নয়! সে দিন মন ভাল হয়ে গিয়েছে ম্যাচের শেষে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল আর জাতীয় পতাকা হাতে কয়েকটি যুবকের হাসিমুখ দেখে। এই আমাদের মাটি, এই আমাদের বাংলার ফুটবল।

ইস্টবেঙ্গল কাঁটাতার পেরিয়ে পুবে চলে গেলে তা যে আর ইস্টবেঙ্গল থাকবে না! আর, মোহনবাগানের সঙ্গে ডার্বিই বা খেলবে কে?

যুগ্ম সহ-সম্পাদক, মোহনবাগান ফ্যানস ক্লাব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

East Bengal Mohun Bagan Derby
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE