Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসের গুনুটিয়া কুঠি ধ্বংসের মুখে

১৭৭৫ সালে তৈরি গুনুটিয়ার রেশম কুঠি আজ তিলে তিলে চিরবিদায় নিচ্ছে অজান্তেই। আমাদের চারপাশে অনেক জিনিস থাকে যা আমাদের অজানাই থেকে যায়। কিছুটা এমনই বিচিত্র গল্প এই কুঠিটি ঘিরে। খুব শীঘ্র হয়তো অস্তিত্বই থাকবে না তার। হারিয়ে যাওয়ার আগে কুঠির ইতিহাস জানা দরকার। সেটাই জানাচ্ছেন মধুরিমা ঘোষ।১৮০৪ সাল অর্থাৎ ফ্রুশার্ডের আমলে যেখানে বিনিয়োগ ছিল ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা, সেখানে চিপ সাহেবের সময় ১৮০৯ সালে বরাদ্দ টাকার অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা!

ভগ্নপ্রায় গুনুটিয়া কুঠি।

ভগ্নপ্রায় গুনুটিয়া কুঠি।

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৯ ০২:২৪
Share: Save:

কী করে আমরা এত অকৃতজ্ঞ হতে পারি? কুঠিটি বছরের পর বছর নিজের উর্বর মাটি, জল, হাওয়া দিয়ে এলাকাটিকে করেছে স্বচ্ছল। তুঁত চাষি, পলুপোকা পালনকারী ও অন্যান্য কর্মী মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার লোকের মুখে আহার জুগিয়েছে এক কালে। উইলিয়াম উইলসন হান্টার তাঁর ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট’ গ্রন্থে (১৮৭৬) লিখেছেন, ‘‘Enclosing a space large enough for a little town...This village is the centre of silk industry in Birbhum.’’

এই গুনুটিয়া কুঠিই অতীতে সর্ববৃহৎ শিল্প অট্টালিকা উপহার দিয়ে বীরভূমকে করেছিল উজ্জ্বলতম। আজ সেই কুঠি শীর্ণকায়, বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে আত্মগোপন করে। অনাদরে অবহেলায় যার শরীরে ধরেছে ঘুণপোকা। গজিয়ে ওঠা হাজার হাজার গাছ নিদর্শনগুলি খেয়ে ফেলছে অনায়াসে। চারদিকে শুধু অপ্রবেশ্য জঙ্গল আর জঙ্গল। ইদানিং কুঠি ঘিরে প্রাচীর স্থানে স্থানে টিকে আছে খালি,বেশিরভাগই হয় মাটি চাপা পড়ে নয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।একটা একটা করে মিটিয়ে যাচ্ছে স্মারকচিহ্নগুলি।

ময়ূরেশ্বরের আমড়া গ্রাম লাগোয়া ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর তীরে কুঠি বাড়ি। গুনুটিয়া কুঠির ইতিহাস জানার জন্য রেশম শিল্প সম্পর্কে দু-এক কথা না বললেই নয়। ইতিহাস বলে, বাংলায় রেশমের চাষ হত গুনুটিয়া কুঠি গড়ে ওঠারও আগে। সপ্তদশ শতকে বীরভূমের রেশম বস্ত্রের বিশেষ খ্যাতিও ছিল। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বাংলার রেশমি কাপড়ের বাজার হ্রাস পেলেও একই সঙ্গে কাঁচা রেশমের চাহিদা বাড়তে থাকে। এ সময় ইংরেজ, ফরাসি, আর্মেনীয়, ওলন্দাজেরা এবং অন্য দেশীয় ব্যবসায়ীরা কাঁচা রেশম উৎপাদন শিল্পে শামিল হন। ১৭৭৫ সালে ব্রিটিশ বণিক এডওয়ার্ড হে তখন তৈরি করেন গুনুটিয়া কুঠি। তদানীং ময়ূরাক্ষী নদী আর পাঁচটা নদীর মতোই নাব্য থাকায় কোম্পানির বড় বড় জাহাজ ও বাণিজ্যিক নৌকা সহজেই প্রবেশ করতে পারত। বারো মাসের এই নাব্যতার সুযোগ-সুবিধা থাকায় এখানেই কুঠির গোড়াপত্তন করা হল।

১৭৭২ সালে বাংলায় আসেন ফরাসি বণিক জেমস্ ফ্রুশার্ড এবং তাঁকে ‘কমার্শিয়াল এজেন্ট’ হিসাবে নিযুক্ত করল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সালটা ছিল ১৭৮৫। ফ্রুশার্ড সাহেব তখন কুড়ি হাজার টাকায় গুনুটিয়া কুঠি কিনে নিলেন এডওয়ার্ড হে-এর কাছে থেকে। এই তৎপর বণিকের হাতেই প্রথম কুঠিটির অভূতপূর্ব উত্থান ঘটল। তিনি দায়িত্ব নিয়ে আশপাশের জঙ্গল সাফ করে কুঠির পরিধি বাড়ালেন। এ ভাবে নিজস্ব তুঁত চাষের জন্য মোট ২,৫০০ বিঘা জমি বন্দোবস্ত করে ফেললেন। গরিব চাষিদের কথা ভেবে দাদন (অগ্রিম অর্থ প্রদান) দেওয়ার মাধ্যমে পুঁজি সরবরাহ করতেন। ইতালীয় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রেশম উৎপাদনের পরিকাঠামো গড়ে তোলেন। বীরভূম জেলায় ইউরোপীয় পদ্ধতিতে রেশম তৈরির সেই প্রথম শুরু। কাঁচা রেশম উৎপাদনের জন্য ফ্রুশার্ড ২০০টি বিশাল লৌহভাণ্ড নির্মাণ করান। স্থানীয় মজুরদের নতুন পদ্ধতি তালিম দেওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকা থেকে কয়েকশো লোক এনে কাজে লাগিয়ে দেন। এঁদের থাকার জন্য তিনি নিক্কর জমি দান করেন।

কিন্তু কুঠির সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হল না। তাঁর শিল্পোদ্যোগে বাধ সাধল খামখেয়ালি ময়ূরাক্ষী নদী আর তার ঘনঘন বন্যা। বন্যা এসে বারবার তুঁত জমির উপর ২-৩ ফুট বালি চাপিয়ে দিয়ে যেত। তখন সেই অনাবাদী জমিতে চাষ হয়নি বছরের পর বছর। নদীতীর বাঁধাতে বহু খরচ করলেও নিষ্ফল হয়েছে সে-সব চেষ্টা। পার্শ্ববর্তী রাজনগরের তদানীন্তন রাজা মহম্মদ উলজামান খানের কাছে সংস্কারসাধনের জন্য ফ্রুশার্ড ১৭৯১ সালে একর প্রতি বাৎসরিক ৩ টাকা ৪ আনার খাজনার চুক্তিতে ১২ বছরের মেয়াদে ওই ২,৫০০ বিঘা জমি বন্দোবস্ত করে নেন। ধার্য খাজনার উচ্চ হার তিনি দিতে সমর্থ হননি। এ ছাড়া কলকারখানা বিশালাকৃতির করে গড়ে তুলতে যে ৬০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন, সেই খাতে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বছরে ৭ হাজার টাকা করে সুদ চোকাতে হয়েছে। রাজরোষ এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘাত হেতু শেষ বয়সে তাঁকে গ্রেফতারির ভয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হল! শেষ পর্যন্ত বিপুল আর্থিক ঋণের বোঝা সঙ্গে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে ১৮০৭ সালে কুঠি বাড়িতেই মারা গেলেন জেমস ফ্রুশার্ড।

ব্রিটিশ সরকার ১৮০৮ সালে জমি-সহ এটি কিনে নেয় ১৫,৮০০ টাকা দিয়ে। পরে ব্যবসার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় সোনামুখীর ‘কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট’ তথা বোলপুরের সুরুল কুঠির মালিক জন চিপের হাতে। তাঁর পরিচালনায় গুনুটিয়া কুঠির উত্তোরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হয়। এই জেলায় অন্য অনেকগুলি কুঠিতে রেশম শিল্পে বিনিয়োগের সম্পূর্ণ ভার দেওয়া হয় তাঁকে। এগুলির কাজকর্ম পরিচালনার জন্য তিনি সুরুল কুঠিকে প্রধান পরিচালন কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিলেন। ভাগ্যও সদয় ছিল বলতে হবে। কেননা তাঁর আমলে দেশীয় সুতি কাপড়ের অর্থাৎ যাকে বলে গড়া শিল্পে ব্যবসায় ভীষণ মন্দা নেমে আসে এবং কোম্পানি সেই টাকা রেশম শিল্পে বিনিয়োগ করতে থাকে। এ ছাড়া ইউরোপে নেপোলিয়নের যুদ্ধের জন্য ইটালি এবং অন্যান্য দেশ থেকে ইংল্যান্ডে কাঁচা রেশম আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ সমস্ত বাড়তি সুবিধা রেশম শিল্পের কপাল খুলে দিল।

১৮০৪ সাল অর্থাৎ ফ্রুশার্ডের আমলে যেখানে বিনিয়োগ ছিল ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা, সেখানে চিপ সাহেবের সময় ১৮০৯ সালে বরাদ্দ টাকার অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা! ১৮২৩ সাল নাগাদ লগ্নির পরিমাণ পৌঁছয় বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকায় এবং উৎপাদিত হয় প্রায় ১,৮০০ মন কাঁচা রেশম। সেই সময়কার বাজারে ক্ষমতার বিচারে কুমারখালির পর গুনুটিয়া কুঠি ছিল দ্বিতীয়। যদিও কুমারখালির অধীন অনেকগুলি সহযোগী কুঠি থাকলেও একক কুঠি (প্রিমাইসেস) হিসেবে গুনুটিয়ায় ছিল অবিভক্ত বাংলায় সর্ববৃহৎ। এর ভূয়সী প্রশংসা করে ১৮১৯ সালে কোম্পানির ‘বোর্ড অফ ডিরেকটর্স’ বলেছে —“Proved in general of excellence, colour and quality, free, tolerably clean and excellent.” ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গুনুটিয়া কুঠির অধীনে কোটাসুর, সুমারগঞ্জ ও মণিপুরের মতো কারখানাগুলি প্রসারণও যুক্ত করা হয়।

এখানে জনান্তিকে বলে রাখি জন চিপ আর পাঁচ জন অত্যাচারী কুঠিয়ালদের মতো ছিলেন না। স্থানীয় লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে তাঁদের বোঝার চেষ্টা করতেন, তাঁদের বিবাদ শুনে তার নিষ্পত্তি করতেন। নানা জনহিতকর কাজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। ৪১ বছর রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকার পর ১৮২৮ সালে ৬২ বছর বয়সে কুঠি বাড়িতেই মারা যান। এখানেই তিনি সমাধিস্থ।

এর পরে কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট পদে যোগ দেন মিস্টার শেক্সপিয়ার। ১৮৩৫ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গুনুটিয়ার পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ‘বেঙ্গল সিল্ক কোম্পানি’। এ কথা জানা যায়, ১৯১০ সালে প্রকাশিত এলএসএস ও’মালির ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস: বীরভূম’ থেকে। পরে দেশীয় জমিদার ও বণিকেরা রেশম শিল্পে মনোনিবেশ করায় প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়তে থাকে। প্রসঙ্গত জমিদারের খাজনা বৃদ্ধি আর একটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে, চাহিদার তুলনায় তুঁত ও পলুর চাষ বাড়েনি। খাদ্যাভাবে রেশমের গুটি উৎপাদন ও তার মান, দুই-ই হ্রাস পায়। রেশম গুটিতে তাপ দেওয়ার জন্য যে-সব তন্দুর বা উনুন এবং বেসিন ছিল, সেগুলি অকেজো হতে শুরু করে। নানা সমস্যায় কোম্পানি আর রেশম চাষে উৎসাহ দেখায়নি। ফলে তা ব্যক্তি মালিকানায় পরিণত হয়।

হাল আমলের গুনুটিয়া কুঠিকে পোড়ো বাড়ি ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়?

এক সময় অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ রেশম কুঠিগুলির অন্যতম হিসেবে যার পরিচিতি রাজ্য তথা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপেও পৌঁছেছিলো, বর্তমানে মানুষ তার ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। এমনকি নির্দ্বিধায় অনেকে এটিকে নীল কুঠি বলে ভুল করে আসছেন। রেশমের পাশাপাশি নীল, লাক্ষা ও চিনির কারবার হত বলে অনেকে মনে করেন। যদিও নীল চাষ যে সত্যিই হত, তার প্রামাণ্য নথি মেলে না। এলাকার মানুষজনের কাছে নীল কুঠি হিসাবে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল একটি রেশম কুঠি। প্রত্ন-আইন অনুসারে শতবর্ষ অতিক্রান্ত স্থাপত্যকে অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতেই পারে সরকার। সরকার গুনুটিয়া কুঠির সংরক্ষণের দায়িত্ব নিলে হাতে গোনা যে ক’টি স্মারকচিহ্ন অবশিষ্ট, তা রক্ষা পাবে এবং নদীতীরে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত কুঠি বাড়ি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করবে।

(লেখক বিশ্বভারতীর তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, মতামত নিজস্ব)

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Gunutia Kuthi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE