সাড়ে পাঁচ মাসের শিশুকন্যাকে কলকাতার নির্মলা শিশুভবন থেকে নিয়ে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদের শিক্ষক ইরা বেগম ও তাঁর স্বামী বাইজিদ হোসেন। সেই কন্যার বয়স এখন একুশ। ইরা বেগম মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। ইসলামি আইনে অনাথ, এতিম শিশুর লালনপালনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। শিশুটি মা-বাবা বলে ডাকতেও পারে। কিন্তু আইনত তাঁরা কেবল অভিভাবক, পিতা-মাতা নন। দত্তক গ্রহণের উপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। শরিয়ত অনুযায়ী জৈবিক সন্তানের সমান অধিকার পেতে পারে না পালিত সন্তান, পালক পিতামাতার সম্পত্তির উপর আত্মীয়দের অধিকার, সেই সন্তানের নয়। তাই বসতবাড়িটি মেয়ের নামে লিখে দিলেন ইরা। ‘‘আমাদের কিছু হলে আত্মীয়রা তাড়িয়ে দিয়ে সম্পত্তি ভাগ করে নিলে ওর কিছু করার থাকবে না।’’ সন্তানের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে বেঁচে থাকতেই সম্পত্তি দান করতে হচ্ছে মুসলিম পিতামাতাকে। ইরা বলছেন, ‘‘পরে মেয়ে-জামাই যদি এই বাড়িতে আমাদের থাকা পছন্দ না করে সেটা মেনে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু আরও বেশি কষ্ট মেয়ের ভবিষ্যৎ অসুরক্ষিত করে রাখা।’’
এ দেশে মুসলিমদের জন্য দত্তক গ্রহণের আইন তৈরি না হওয়ায় পিতামাতা ও সন্তান, উভয়েই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। প্রয়োজন আইনে সংশোধনের। ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখদের ক্ষেত্রে পারিবারিক আইন বলছে, দত্তক সন্তান পিতামাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। একই আইন এ দেশের সন্তানকামী মুসলিম মা-বাবার জন্যও থাকবে না কেন? এই প্রশ্ন নিয়ে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন সমাজকর্মী ও মানবাধিকার কর্মী শবনম হাসমি। মুসলিম আইন তাঁকে কেবল অভিভাবকত্ব দেবে, মায়ের অধিকার দেবে না কেন? ২০১৪ সালে শীর্ষ আদালত রায় দেয়, ভারতের মুসলিমরাও দত্তক নিতে পারবেন। ধর্ম এখানে কোনও বাধা নয়। রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান মনে করেন, এই রায়ের পর আর আইন প্রণয়ন করার দরকার নেই। তিনি নিজেও সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় বেরোনোর পরে তাঁর পালিত কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক ‘রিভিউ’ করিয়ে নেন। এখন সে দত্তক কন্যা, পালিত সন্তান নয়। জৈব সন্তানের মতোই পিতামাতার সম্পত্তির পূর্ণ উত্তরাধিকারী। ফলে মুসলিম পিতামাতা ও দত্তক সন্তানের অধিকার এখন সুরক্ষিত, মনে করছেন মইনুল হাসান। কলকাতা ও সিকিম হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত অবশ্য মনে করেন, আইন থাকলে সব স্তরের মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করা যায়। কেবল আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করতে হলে তা সম্ভব নয়। রায় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিছু নাগরিকই তার সুযোগ নিয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে পারেন। তাই মুসলিমদের দত্তক আইন আবশ্যক।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শারীরিক কারণে অনেকে সন্তান ধারণে অক্ষম। কিন্তু এই বিশ্বায়িত ভুবনে তরুণতরুণীরা কেউ পেশাগত কারণে, কেউ বা স্বেচ্ছায় সন্তানধারণ করেন না। নিজের সন্তান মানেই জৈব সন্তান, এটাও এখন আর সকলে ভাবেন না। ধর্মের বেড়া দিয়ে মুক্ত ভাবনাকে আটকে রাখা মানবাধিকার বিরোধী। অনাথ শিশু ও সন্তানকামী পিতামাতার মধ্যে ধর্ম কেন বাধা হবে? কেবল অভিভাবকের কর্তব্য বা দাক্ষিণ্যের উপরে সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অধিকারের বৃত্তেই গড়ে ওঠে মজবুত সম্পর্ক। সুন্দর, নির্ভয় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই আইনের সুরক্ষা।
সুরক্ষার প্রয়োজন মেয়েদেরও। বহু দাম্পত্য ভেঙে যায় সন্তান না থাকার কারণে। বিশেষত সন্তান ধারণের সমস্যা যদি মেয়েদের হয়। কার সমস্যা, সেটা পরীক্ষা না করেই অনেক সময়ে দোষারোপ চলে মেয়েটির ওপর। মুসলিম পারিবারিক আইন পুরুষদের বহুবিবাহ অনুমোদন করেছে, ভারতে এই আইন এখনও প্রচলিত। সুযোগসন্ধানী পুরুষরা সন্তান পাওয়ার দোহাই দিয়ে আবার বিয়ে করেন। অনেকে পূর্বের স্ত্রীকে ‘বন্ধ্যা’ অভিযোগে তালাক দেন। বীরভূম জেলার মুরারইয়ে সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীকে তালাক দিলেন স্বামী। আবার বিয়ে। পরের স্ত্রীও সন্তানের জন্ম দিতে পারলেন না। স্ত্রী নির্যাতনের (তালাক দেওয়া ও আবার বিয়ে করা) অপরাধে পুরুষটির কিন্তু বিচার হয়নি। ভারতে মুসলিম পারিবারিক আইন মৌখিক বলে তার ব্যবহারিক প্রয়োগে মেয়েরা অত্যাচারিত হন।
মুসলিম মেয়েদের সুরক্ষা চাইলে কেবল মৌখিক তালাক নিষিদ্ধ করলে হবে না। সংবিধান স্বীকৃত আইন দরকার, যা দত্তক সন্তানকে জৈব সন্তানের সমান অধিকার দেবে, এবং দত্তক গ্রহণকারী দম্পতি পাবেন পিতামাতার মর্যাদা। সংরক্ষণশীল অংশ হয়তো গোড়ায় মানতে পারবে না এই পরিবর্তন। কিন্তু যে সঙ্কট বহু মানুষকে বিপন্ন করছে, আইনে তার সমাধান মিললে মানুষ তার শরণ নেবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy