শ্রদ্ধা: বিদ্যুতের তারে হাতির মৃত্যুর পরে মূর্তি বসিয়ে পুজো। —নিজস্ব চিত্র।
সেদিন সকালে হাতি মৃত্যুর খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছিলেন প্রমীলা মাহাতো। আলু খেতে দু’টো হাতির দেহ পড়েছিল। খেতের পাশে গালে হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন প্রমীলা। বছর পঞ্চান্নর মহিলা। একটু তাকালেই বোঝা যাবে, প্রমীলার গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা। প্রমীলা বলছিলেন, ‘‘আমাদের জমির কিছু ফসলও নষ্ট করেছে। পড়শির একটা ঘর ভেঙেছে। তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু এ ভাবে হাতি দু’টো মরে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল।’’
মেদিনীপুর সদর ব্লকের নেপুরার ঘটনা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে মারা গিয়েছিল পূর্ণবয়স্ক দু’টো হাতি। কাতারে কাতারে মানুষজন ভিড় করেছিলেন। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে ‘শেষ দেখা’ দেখার ভিড়। কেউ ‘হাতি ঠাকুরের’ পায়ের কাছে ফুল রেখে যান। কেউ ধূপ জ্বালেন। মেদিনীপুরের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহা গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। বলছিলেন, ‘‘সেদিন দেখেছিলাম, গ্রামের অনেকেরই মন খারাপ।’’
কিন্তু পেট যে শোক মানে না। এখন সারা বছর ধরেই হাতির আনাগোনা জঙ্গলমহলে। আর মাঝে মাঝেই শোনা যায়, হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বের কথা। দ্বন্দ্ব মানে অধিকারের লড়াই। ফসলের অধিকার। খিদে মেটানোর অধিকার। গ্রামবাসীরা জমিতে ফসল ফলায়। সেটাই তার সারা বছরের খোরাক। আবার জঙ্গলের হাতি খাবার না পেয়ে বা অন্য কোনও কারণে লোকালয়ে চলে আসে। তারাও পেট ভরাতে সেই ফসলের উপরেই তাদের দাবি জানায়। ফলে হাতি তাড়াতে নামাতে হয় হুলাপার্টি, গ্রামবাসীরাও পিছু নেয়। দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়।
ঝাড়গ্রামের জামবনির ডুমুরিয়ায় ট্রেনের ধাক্কায় মৃত হাতিকে পুজো। —নিজস্ব চিত্র।
সূত্রপাত কোথা থেকে তা নিয়ে আগে বহু চর্চা হয়েছে। আরেকবারও হতে পারে। একদিকে দলমার দলের জঙ্গলমহলে থাকার সময় বেড়েছে। দলে হাতির সংখ্যাও বেড়েছে। অন্যদিকে, দলমার পরিযায়ীদের পাশাপাশি রেসিডেন্সিয়াল হাতির সংখ্যাও বেড়েছে। এই দুইয়ের জেরে হাতির হানা বেড়েছে বলে দাবি বনকর্তাদের একাংশে। এক সময়ে দলমা দল দক্ষিণবঙ্গে ২-৩ মাস থাকত। এখন থাকে ৮-১০ মাস! বন দফতরের সূত্র বলছে, দক্ষিণবঙ্গে স্থায়ীভাবে হাতি ছিল না। ১৯৮৭ সালে প্রথম বিহারের দলমা থেকে প্রায় ৫০টি হাতির দল ঝাড়গ্রামে আসে। তখন এদের গতিবিধি কংসাবতী নদীর ওপার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে এরা অঞ্চল বাড়িয়ে নেয়। কংসাবতী নদী পার হয়ে মেদিনীপুর সদর, শালবনি, গোয়ালতোড়, গড়বেতা, বিষ্ণুপুর হয়ে দ্বারকেশ্বর নদী পার হয়ে বাঁকুড়ার সোনামুখী, পাত্রসায়রে চলে যেতে শুরু করে। এখন দলমার যে দল এখানে আসে তাতে ১৪০-১৫০টি হাতি থাকে। এই সময়ের মধ্যে রেসিডেন্সিয়াল হাতির সংখ্যাও বেড়েছে। সংখ্যাটা প্রায় ৫০।
কেন জঙ্গলমহলে হাতি বেশিদিন থাকছে? কারণ খুঁজেছেন বনকর্তারা। এক, জঙ্গল তথা হাতির বাস করার মতো পছন্দসই পরিবেশের সার্বিক উন্নতি হয়েছে এখানে। দুই, অফুরন্ত খাদ্যের জোগান। জঙ্গল ও পাশ্ববর্তী চাষাবাদের অঞ্চল থেকে জলের পর্যাপ্ত জোগান পাচ্ছে। তিন, জঙ্গলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে বাড়িতে খাদ্যের অপরিসীম মজুত ভাণ্ডার থাকছে। চার, হাতি তাড়ানোর সময় হাতিদের সঙ্গে কঠোর ও নিষ্ঠুর আচরণ না করা। পাঁচ, জঙ্গল নিকটবর্তী লোকালয়ে অসংখ্য দেশি মদের ভাটি। যা খুব সহজে বুনো হাতির দলকে আকৃষ্ট করছে।
বন দফতর সূত্রের খবর, দেশের মোট হাতির মাত্র ২ শতাংশ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। অথচ, বছরে দেশে হাতির হানায় মৃত্যুর ১৯ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গে। সঙ্গে রয়েছে জখম হওয়া। হাতির হানায় গবাদি পশু, ঘরবাড়ি, শস্যের ক্ষতি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষতি সামলানো গ্রামবাসীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। নেপুরার বাসিন্দা স্বপন বেরা। স্বপনের শহরে পান গুমটি রয়েছে। জমি জমা সামান্যই। অথচ পরিবারে চারজন সদস্য। একই গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত ঘোষ চাকরি করেন না। তাঁর কয়েক বিঘা জমি আছে। জমির উপরেই পুরো পরিবার নির্ভরশীল। এঁদের জমিতে যদি হাতির দল নামে এঁরা আতঙ্কিত হবেনই। তার উপর যদি কারও মৃত্যু ঘটে তাহলে সেই ক্ষতিটাও বড় ক্ষতি। উপার্জনক্ষম কেউ মারা গেলে তার প্রভাব বেশ ভাল ভাবেই পড়ে পরিবারগুলোর উপরে। গত ন’মাসে যেমন মেদিনীপুর ডিভিশনে ১১ জন মারা গিয়েছেন হাতির হানায়।
তাই গ্রামবাসীরা হাতি তাড়াতে দল বাঁধেন। কিন্তু হাতির ক্ষতি চান না কেউই। সন্ধ্যা দাসের কথায়, ‘‘হাতি অসুস্থ হলে গ্রামের লোকেরা সেবাযত্নও করেন। এ ভাবে হাতির মৃত্যু মানা যায় না।’’ ছায়া মাঝির কথায়, ‘‘হাতির মৃত্যু অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমরা ভাবছিলাম, হাতি ভাল ভাবে তার জঙ্গলে ফিরে যাবে। তার আগেই এই ঘটনা (নেপুরায়)।’’ ছায়া বলছিলেন, ‘‘প্রায়ই হাতি এলাকায় আসে। লোক মারে, ঘরবাড়ি ভাঙে, ফসল নষ্ট করে। বন দফতরের কাছে আমরা হাতি তাড়ানোর দাবিও তুলি। না-হলে ফসলের ক্ষতি হবে যে। তা-বলে কখনও হাতির মৃত্যু কামনা করি না।’’
তাঁরা যে তা করেন না তা হাতি দু’টোর মৃত্যুর পরে এগারো দিনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আয়োজন থেকেই বোঝা গিয়েছিল। কয়েকশো গ্রামবাসীকে পাত পেড়ে খাওয়ানোও হয়েছে। উদ্যোক্তা গ্রামবাসীদের তরফে সুব্রত ঘোষ বলছিলেন, ‘‘হাতি মারা যাওয়া মানে দেশের অমঙ্গল। দেশের মঙ্গলকামনায় ওই দিন পুজোপাঠ হয়েছে। হাতির আত্মার শান্তি কামনা করেই শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয়েছিল।’’ পুরোহিত চন্দন মিশ্রের কথায়, ‘‘দেশের মঙ্গলকামনায় ওই পুজোপাঠ হয়েছে। হাতির আত্মার শান্তি কামনাও করা হয়েছে।’’ জোড়া হাতির মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সামনের বছর থেকে নেপুরায় মেলার পরিকল্পনা করছেন গ্রামবাসীরা। অনেকে এই উদ্যোগকে বিশ্বাস থেকে জন্মানো অনুভূতি বলতে পারেন। কিন্তু মেলার আয়োজনের কথা শুনে মেদিনীপুরের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহা বলছিলেন, ‘‘পশুদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা রয়েছে। এটা থাকা জরুরিও।’’
সেই বিশ্বাস বা ভালবাসায় ঘাটতি হবে না হয়তো। কিন্তু ফসলের উপরে হামলা হলে মানুষ ক্ষিপ্ত হবেনই। সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী বন দফতর। হাতির সাধারণ গতিপথের উপর নয়। কিছু বিশেষ গ্রাম বা জঙ্গল সন্নিহিত এলাকায় পরিখা খোঁড়া হয়েছে। পরিখা এতে হাতির সাধারণ গতিপথ থেকে দিকভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে। জঙ্গলে বাঁশ, চালতা প্রভৃতি গাছ লাগানো হচ্ছে। এ সব হাতির প্রিয় খাদ্য। জঙ্গল এবং লোকালয়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় কাঁটাগাছের বেড়া তৈরি এবং ঔষধি গাছ রোপণ করা হয়েছে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। হাতি উপদ্রুত এলাকায় বেশি হারে লঙ্কা চাষের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। মেদিনীপুরে এসেছিলেন বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন। তিনি বলেন, ‘‘হাতি এমন বুদ্ধিমান প্রাণী যে এর সঙ্গে মোকাবিলা করা কঠিন। মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। এদের অভিযোজন করার ক্ষমতা অনেক বেশি। আমরা যত রকমভাবে এদের আটকানোর চেষ্টা করি না কেন, এরা তাকে অতিক্রম করে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।’’ তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘হাতি আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’’
সেই ব্যথা থেকেই জন্ম দ্বন্দ্বের। পেট আর হাতিঠাকুরের দ্বন্দ্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy