Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বার্তা এল, ‘আমরাই ভ্যানগার্ড’

এক দিকে মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছেন, অন্য দিকে বিপুল বৈভব, যার কিছু অংশ চুইয়ে পড়ছে গ্রামগুলোতে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনে যে ফল পাওয়া গেল, তার কারণ নিয়ে কিছুটা আলোচনা আগের পর্বে (‘ঝাড়খণ্ডে জয় হল লোকবুদ্ধির’, ২৬-১২) করা হয়েছে। তার সূত্র ধরে প্রথমেই বলা দরকার রাজ্যের শিক্ষাচিত্রটির কথা। সে চিত্র, এক কথায় বললে, ভয়ানক। ২০১১-র হিসেবে সাক্ষরতার হার মাত্র ৬৬ শতাংশ। স্বাস্থ্যের অবস্থা শোচনীয় বললে কম বলা হয়— জন্মকালীন গড় আয়ু জাতীয় গড়ের চেয়ে দু’বছর পিছিয়ে। আরও দুশ্চিন্তার কথা, যেখানে বিশ্ব জুড়ে পুরুষ অপেক্ষা নারীদের দীর্ঘজীবী হওয়াটাই জৈব-সামাজিক নিয়ম, সেখানে এ-রাজ্যে নারী-পুরুষের গড় আয়ুতে পার্থক্য অতি সামান্য। এর কারণ, নারীরা স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযোগ প্রায় পানই না। তার কারণ, প্রাথমিক স্তরে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে প্রায় কিছু নেই। এবং এ-সবের কারণ হল, সরকার এ ব্যাপারে আদৌ নজর দেয়নি।

এরই সঙ্গে আছে চরম বৈষম্য। এক দিকে মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছেন, অন্য দিকে বিপুল বৈভব, যার কিছু অংশ চুইয়ে পড়ছে গ্রামগুলোতে, এবং গরিবদের চোখে আঙুল দিয়ে তাঁদের দারিদ্রকে দেখিয়ে দিয়ে ধর্ষকাম মজা পাচ্ছে।

এই অসাম্য রাজনীতিতেও প্রতিফলিত। টাকার থলে নিয়ে বৃহৎ বিরোধী দলগুলোর খুব অনীহা আছে এমন মনে করার ভিত্তি নেই। বিজেপির মতোই জেএমএম দলেরও বিজয়ী বিধায়কদের তিন-চতুর্থাংশই কোটিপতি (আশ্চর্যজনক ভাবে কংগ্রেসে বেশ কম, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ)। মুখ্যমন্ত্রী হতে যাওয়া জেএমএম নেতার ঘোষিত সম্পত্তিমূল্য আট কোটি টাকার বেশি, তাঁর ভ্রাতৃজায়া বিধায়কের সম্পত্তি দু’কোটির ওপরে। দেশের অন্যত্র এই পরিমাণ টাকা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, কিন্তু যে রাজ্যে এখনও আদিবাসী শিশু ভাদ্র-আশ্বিনে ভাতের জন্য কাঁদে, কেটে নেওয়া ভুট্টার গাছ ক্ষুধা নিবারণে আখের মতো করে চিবিয়ে খায়, শুধু পেটে ভাতে ‘ভাতুয়া’ খাটে, যে রাজ্যে ৩৭ শতাংশ লোক দারিদ্র সীমার নীচে, ৩৫ শতাংশ লোক খেতমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন, এবং কোটি টাকা মানে ঠিক কত সেটাই বহু লোক কল্পনায় আনতে পারেন না, সেখানে এই টাকাই নেতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিত্তবৈষম্যকে উৎকট, অশ্লীল করে তোলে।

এত কিছুর পরও লোকে জেএমএম-কংগ্রেস জোটের সরকার গড়ার পক্ষে যে এত স্পষ্ট রায় দিলেন, তা কেবল ঝাড়খণ্ডের বিশেষ পরিস্থিতির ব্যাপার নয়। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস পরাজয়ের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁর নেতাদের আড়াল করা তাঁর কর্তব্য, কিন্তু সাধারণ বুদ্ধির কর্তব্য অন্য ভাবে নির্ধারিত হয়। কাণ্ডজ্ঞান থেকে আমরা যে ব্যাখ্যা পাই, তা তিন কোটি লোকসংখ্যার এই প্রদেশের দরিদ্র, সুযোগবঞ্চিত, অপমানিত লোকসাধারণের মহত্তর উপলব্ধির দিকেই তাকাতে বলে। তাঁদের অনেকেই জানেন না, কোন নেতার কত টাকা। নতুন সরকার তাঁদের জন্য স্বর্গরাজ্য গড়ে দেবে— এমন প্রত্যাকাঙ্ক্ষা তাঁদের নেই। রাজনীতি স্ফটিকস্বচ্ছ হয়ে উঠবে, দুর্নীতির কলুষ তার ধার মাড়াতে পারবে না— নিজেদের তাঁরা এমন কোনও কল্পনারও হকদার বলে মনে করেন না। উল্টো দিকে, তাঁদের বেশির ভাগই এনআরসি, সিএএ, ৩৭০, বাবরি মসজিদ, তিন তালাক ইত্যাদি নিয়ে প্রায় কিছুই শোনেননি। কিন্তু অভিজ্ঞতাসঞ্জাত মানবিক বোধে তাঁরা এটা জেনেছেন যে, কোথাও একটা সাঙ্ঘাতিক গোলমাল হয়ে চলেছে। তাঁরা জেনেছেন এই দেশটার অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন। বর্তমান শাসকেরা তাকে এমন এক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে মানুষের কথা বলা অপরাধ, সরকারের বিরোধিতা করা ঘোরতর পাপ। এই দুর্ভাগ্যের বার্তা পড়বার জন্য নিরক্ষরতা তাঁদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

হুমকির ভাষা বোঝার জন্য অক্ষরপরিচয় লাগে না। যদি লাগত, তা হলে এই দেশটা গড়েই উঠত না। স্বাধীনতার লগ্নে ব্রিটিশ সাংবাদিক বলেছিলেন, বড় জোর দশ বছর, তার মধ্যেই ভারতীয় গণতন্ত্র নামক বস্তুটাই থাকবে না। ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি। মেলার কথা নয়। ভারতবর্ষের নির্মাণে যেমন বহুত্বই ভিত্তি, তার সুরক্ষাতেও সেই বিভিন্নতাই শক্তি। এনআরসি/সিএএ-র বিরুদ্ধতার পথ ধরে এ রাজ্য-সহ সারা দেশে বিভিন্ন পার্টি-ছাত্রদল-নাগরিক সমাজের যে আলাদা আলাদা সমাবেশ, সেটা যেমন ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদী কাঠামোটি ভেঙে ফেলার উপক্রমকে পর্যুদস্ত করার লড়াই, ঝাড়খণ্ড নির্বাচনও সেই ধারায় একটি যোগদান। এটা আসলে বিরোধী দলগুলোর কাছে লোকসাধারণের একটা বার্তা: “আমরাই ভ্যানগার্ড, তোমরা আমাদের অনুসরণ করো।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jharkhand Assembly Elections Hemant Soren
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE