Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
জগদীপ ধনকর

ঐতিহাসিক ভুল

১৯০৫ সালে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ করিবার সেই দুরভিসন্ধি এবং চুক্তি-পরবর্তী প্রবল প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের সম্মুখীন হইয়া ছয় বৎসর পর চুক্তি রদের সামগ্রিক ইতিহাসটি শ্রীধনখড়ের অজ্ঞাত থাকিতে পারে, কিন্তু বাঙালি তাহা ভুলে নাই।

জগদীপ ধনখড়।

জগদীপ ধনখড়।

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৪৯
Share: Save:

বঙ্গভঙ্গের চুক্তি যে টেবিলে স্বাক্ষর করা হইয়াছিল, মাননীয় রাজ্যপাল তাহাকে ‘আইকনিক’ আখ্যা দিয়াছেন। রাজ্যবাসীকে ইংরাজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইবার সময় তিনি হঠাৎ ‘প্রবাদপ্রতিম টেবিল’-এর প্রসঙ্গ কেন টানিলেন, বুঝা দুষ্কর। তবে তিনি যে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস বিন্দুমাত্র না জানিয়া এবং জানিবার চেষ্টা না করিয়াই মন্তব্যটি করিয়াছেন, তাহা বুঝিতে কষ্ট হয় না। ১৯০৫ সালে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ করিবার সেই দুরভিসন্ধি এবং চুক্তি-পরবর্তী প্রবল প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের সম্মুখীন হইয়া ছয় বৎসর পর চুক্তি রদের সামগ্রিক ইতিহাসটি শ্রীধনখড়ের অজ্ঞাত থাকিতে পারে, কিন্তু বাঙালি তাহা ভুলে নাই। ফলত, রাজ্যপালের টুইট ঘিরিয়া নেটদুনিয়ায় প্রবল আলোড়ন এবং সম্ভবত সেই ধাক্কাতেই টুইট-প্রত্যাহার।

তবে, প্রসঙ্গ এখানে শ্রীযুক্ত ধনখড় নহেন। প্রসঙ্গ, বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে গেরুয়া কাচের মধ্য দিয়া দেখিবার এবং দেখাইবার উদগ্র বিজেপি-সুলভ বাসনা। যাঁহাদের এ যাবৎ কাল দেশবাসী বিশ্বাসঘাতক বলিয়া জানিয়াছেন, বিজেপি তাঁহাদেরই এখন দেশনায়কের সম্মান প্রদানে ব্যস্ত। এবং দেশ গড়িবার কারিগর হিসাবে জনমানসে যাঁহারা এত কাল চিত্রিত হইয়া আছেন, তাঁহাদের খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত করিতে উদ্‌গ্রীব। নাথুরাম গডসের মন্দির নির্মাণ, তাঁহাকে দেশভক্ত বলা, ব্রিটিশদের সঙ্গে আপসে ইচ্ছুক সাভারকরকে মহিমান্বিত করিয়া তুলিবার মধ্যে এই গৈরিকীকরণের ছাপ স্পষ্ট। সম্প্রতি তাহারা যেমন ব্যস্ত ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক দেশভাগ হইতে কাশ্মীর সমস্যা অবধি যাবতীয় দায় কংগ্রস, তথা নেহরুর উপর চাপাইয়া দিতে। অমিত শাহ লোকসভায় বলিয়াছেন, ধর্মভিত্তিক দেশভাগ তাঁহারা করেন নাই, ইহা কংগ্রেসের কীর্তি। ইতিপূর্বে বিজেপি নেতারাও প্রায় তাঁহারই সুরে বলিয়াছেন, নেহরু চাহিয়াছিলেন বলিয়াই ভারত ১৯৪৭ সালে দ্বিখণ্ডিত হইয়াছে। যাহা বলেন নাই বা বলিতে চাহেন নাই তাহা হইল, নেহরু ধর্মভিত্তিক দেশভাগে আদৌ সম্মত ছিলেন না। তাঁহাকে এই কার্যে রাজি করাইবার ভারটি লইয়াছিলেন সর্দার বল্লভভাই পটেল, গুজরাতের সর্দার সরোবর বাঁধের উপর যাঁহার সুবিশাল মূর্তিটির উদ্বোধন করিয়াছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সুতরাং প্রকৃত ইতিহাসকে যাঁহারা হামেশাই নিজ প্রয়োজনে বিকৃত করিয়া থাকেন, তাঁহারা যে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস এবং বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভুলিয়া যাইতে চাহিবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য কী!

শ্রীধনখড়ও যে সেই পথেই হাঁটিয়াছেন, তাহা বলা মুশকিল। সম্ভবত তিনি বাংলার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অবহিতই নহেন। কিন্তু না-জানার মতোই জানিতে না চাহিবার প্রবণতাটিও ভারতীয় সমাজের একাংশের বৈশিষ্ট্য। প্রথমটিকে যদি বা মার্জনা করা যায়, দ্বিতীয়টি অক্ষমণীয়। বিশেষত যে রাজ্যের রাজ্যপাল হিসাবে তিনি নিযুক্ত হইয়াছেন, সেই রাজ্যের ইতিহাস জানিয়া লওয়া কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তাহা নিছক ইতিহাস জানিবার লক্ষ্যে নহে, রাজ্যবাসীর প্রতি সম্মানার্থেই রাজ্যের অতীতকে জানা প্রয়োজন। তাহা না করিয়া এমন এক উত্তপ্ত সময়ে— কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাংলায় এনআরসি হইবেই বলিয়া হুঙ্কার দিতেছেন— তখন রাজ্যপালের এই ‘না জানিবার ইচ্ছা’ চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE