Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বাকিটা ইতিহাস

ইন্দিরা-রাজীবের রাজনৈতিক জীবনের কিছু না-লেখা অধ্যায়

একটু যেন চকিত ইন্দিরা। ‘দেখছি তোমার মনে কোনও সংশয়ই নেই!’ স্যাম-এর জবাব, ‘ম্যাডাম, পূর্ব পাকিস্তান ধসে যাওয়ার পর আমাদের সেনা প্রস্তুত।

রূপকার: রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে স্যাম এইচ এফ জে মানেকশ। রাষ্ট্রপতি ভবন, দিল্লি, জানুয়ারি, ১৯৭৩

রূপকার: রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে স্যাম এইচ এফ জে মানেকশ। রাষ্ট্রপতি ভবন, দিল্লি, জানুয়ারি, ১৯৭৩

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৮ ০০:১৪
Share: Save:

স্যাম, পেশোয়ার পৌঁছতে তোমাদের ঠিক কতক্ষণ লাগবে? কিছুটা আচমকাই জেনারেল মানেকশকে প্রশ্নটা করেছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। মানেকশ উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও বাড়তি খরচ করলেন না। সপাটে জানালেন, ‘ম্যাডাম, দিন তিনেক!’

একটু যেন চকিত ইন্দিরা। ‘দেখছি তোমার মনে কোনও সংশয়ই নেই!’ স্যাম-এর জবাব, ‘ম্যাডাম, পূর্ব পাকিস্তান ধসে যাওয়ার পর আমাদের সেনা প্রস্তুত। জানতাম আপনি এই প্রশ্নটিই এ বার করতে চলেছেন। ফলে আমরা আগে থেকেই হোমওয়ার্ক সেরে রেখেছি।

তৎকালীন সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ-এর লিখিত সমর্থনকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে নিজেদের দখলে নেওয়ার কথা এক বারের জন্য হলেও ভেবেছিলেন ইন্দিরা। একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করার দিনটিতে। সে দিনের সেই বিস্ফোরক বৈঠকের বিশদ বর্ণনা রয়েছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা জি পার্থসারথিকে নিয়ে লেখা তাঁরই পুত্র অশোক পার্থসারথির নতুন বই: জি পি ১৯১৫-১৯৯৫-এ। সে সময় অশোকও ছিলেন ইন্দিরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা। বাবার মতো তিনিও সাক্ষী থেকেছেন ইতিহাসের এখনও পর্যন্ত না-লেখা পাতাগুলির। শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধই নয়, বইটিতে উঁকি মারছে অজানা কূটনৈতিক দৌত্য, দেং শিয়াও পিং-এর অরুণাচল বিষয়ক প্রতিশ্রুতি, রাজীব হত্যার পূর্বাভাস বহন করা প্রভাকরন-জি পি বৈঠক, নেহরুর চিন-নীতি নিয়ে দ্বিধার মতো অনেকানেক মণিমাণিক্য। সময়ের ধুলো ঝেড়ে যা মলাটবন্দি করেছেন অশোক।

ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের সেই দুপুরটিতে। সাউথ ব্লকের ১৫৫ নম্বর ঘরটিতে উপস্থিত তৎকালীন মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির সদস্যরা (অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চহ্বাণ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, বিদেশমন্ত্রী স্বর্ণ সিংহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি) সেনাবাহিনীর তিন প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার, ‘র’-এর প্রধান আর এন আই কাও, জি পার্থসারথি এবং লেখক নিজেও। কিছুক্ষণ আগেই সোভিয়েট খামে একটি চিঠি এসে পৌঁছেছে সাউথ ব্লকে। স্বাক্ষরকারীর নাম লেয়োনেদ ব্রেজনেভ! পূর্ব পাকিস্তানে জয় লাভের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট ইন্দিরাকে লিখেছেন, ‘আপনি যা করেছেন তা এক অনন্য কাজ। একটি নতুন দেশের জন্ম দিয়েছেন। এ বার আপনার এবং আপনার মন্ত্রিসভার সতীর্থদের একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পলিটব্যুরো নিশ্চিত, আপনারা সব দিক বিবেচনা করে ঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। যে সিদ্ধান্তই আপনারা নিন না কেন, সোভিয়েট ইউনিয়নের নিঃশর্ত সমর্থন আপনার জন্য থাকবে।’

ইঙ্গিত স্পষ্ট। মস্কোর কাছ থেকে এই বার্তা পাওয়ার পর ইন্দিরা এক বারের জন্য হলেও যে ভেবেছিলেন ভঙ্গুর পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা পাঠিয়ে পেশোয়ারের দখল নেওয়া, তা অশোক বর্ণিত বৈঠকটির বিবরণ থেকে স্পষ্ট। সেই বৈঠকে মানেকশ-র উত্তর পাওয়ার পর চেয়ার ঘুরিয়ে টেবিলের অন্য দিকে বসা মন্ত্রী এবং সচিবদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা। প্রায় সবাই-ই সে দিন বলেছিলেন পেশোয়ারে সেনা পাঠাতে এবং কালক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে নিতে। প্রধানমন্ত্রী এর পর হাকসারের মতামত জানতে চান। হাকসার কিন্তু স্পষ্ট বলেন, ‘ম্যাডাম, স্যাম যা বলছেন তা করে দেখাতে তিনি সক্ষম, এটা আমি জানি। কিন্তু আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরবর্তী
পদক্ষেপ করতে হবে। আমরা কি পাকিস্তান দখল করব? যদি করি, তা হলে প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ হয়তো বলবে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান মুর্দাবাদ। হিন্দু মুসলিম ভাই-ভাই। কিন্তু ছ’মাস পর কী হবে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তখন কিন্তু আওয়াজ উঠবে ভারতীয় সেনা মুর্দাবাদ, হিন্দুরা ফিরে যাও।’

লেখক জানাচ্ছেন, হাকসারের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই হাত তোলেন জগজীবন রাম। বলেন, ‘ম্যাডাম, হাকসার সাহেব ভুল বুঝছেন। আমরা কেউই আসলে পশ্চিম পাকিস্তান দখল নেওয়ার কথা বলছি না। ’৪৮-এর যুদ্ধে বলপূর্বক যে সব ভূখণ্ড পাকিস্তান ছিনিয়ে নিয়েছিল, যেমন পাক অধিকৃত কাশ্মীর, গিলগিট, বালটিস্তান, সেগুলি তারা ফেরত দিক, এটাই চাইছি।’

সব শুনে মৃদুকণ্ঠে ইন্দিরা কেবল বলেছিলেন, ‘আমি ভেবে দেখছি।’ বৈঠক শেষ হওয়ার পর ইন্দিরা অশোক পার্থসারথিকে নিয়ে যান তাঁর বাড়ি। অশোক লিখছেন, ‘আমার পিঠে হালকা চাপড় মেরে উনি বলেছিলেন, অশোক, আমি জানি তোমরা কী চাইছ। কিন্তু প্রবল গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হবে।’

সে দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইন্দিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা না-পাঠানোর। রাত ৮টায় অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র সম্প্রচারে সংঘর্ষ-বিরতির কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।

একাত্তরের যুদ্ধেরই আরও একটি ঘটনার কথা লিখেছেন অশোক পার্থসারথি। দিনটা ৩ ডিসেম্বর। এক দিন আগেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সোভিয়েট ইউনিয়নের কেজিবি এবং অন্যান্য সূত্রে খবর এসে গিয়েছে ৩ তারিখেই পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করতে চলেছে। এমনই এক থমথমে ভোরে ৬টার সময় ব্যক্তিগত সচিব এন কে শেষন-কে ফোন করলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। জানালেন তিনি গুয়াহাটি যেতে চান। মাথায় হাত সাউথ ব্লকের। এমন সময় দিল্লি ছাড়ার কথা কেন ভাবছেন ইন্দিরাজি। লেখকের জবানিতে, ‘শেষন তৎক্ষণাৎ আমাকে ফোন করেন। খবরটা জানান। তার একটু পরেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রামের ফোন আসে। উনি বলেন, অশোক, ঘটনা শুনেছ? ইন্দিরাজি গুয়াহাটি যেতে চাইছেন! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওঁর বাড়ি যাও আর ওঁকে আটকাও। উনি তোমাকে খুব পছন্দ করেন, তোমার মতামতকে গুরুত্ব দেন। আমি বলি, স্যর আমি ওঁর বিজ্ঞান প্রযুক্তি উপদেষ্টামাত্র। আর আপনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু আপনিও ওঁর বাড়ি পৌঁছন। এর পর সাড়ে সাতটার মধ্যে আমি ইন্দিরাজির বাড়ি পৌঁছে যাই। ওঁকে বলি ম্যাডাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সবাই ঘাবড়ে গিয়েছে আপনি গুয়াহাটি যাচ্ছেন শুনে। আমাদের সবার চেয়ে আপনি ভাল জানেন, আজকের দিনটার গুরুত্ব! কেন তা-ও যাচ্ছেন গুয়াহাটি? ইন্দিরা বলেন, অশোক গোটা বিশ্বকে আমি বোঝাতে চাই, এই অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধটা আমরা শুরু করিনি। ইয়াহিয়া খান আর টিক্কা খান— এই দুই স্বৈরাচারীকেই শুরুটা করতে দাও না! আমি তাঁকে বলি, দিল্লিতে বিমানহানা হতে পারে। ইন্দিরাজি শুধু বলেন, হতে দাও। এর পর সটান গুয়াহাটি চলে যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দিনভর বৈঠক এবং জনসভা সেরে সন্ধ্যা ছ’টায় দিল্লি ফেরেন। ইতিমধ্যে শ্রীনগর, আদমপুরের মতো বড় বিমানঘাঁটিগুলিতে পাকিস্তান বায়ুসেনা বোমা ফেলতে শুরু করেছে। বিমানবন্দর থেকে সোজা সাউথ ব্লকে পৌঁছন ইন্দিরা। সেখানেই তিন সেনাবাহিনীর হাতে সরকারি ভাবে যুদ্ধের ফরমান তুলে দেওয়া হল। সেই রাতেই ন’টা নাগাদ পাকিস্তানের করাচি বন্দর দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ভারতীয় সেনা এগোতে থাকে দু’টি ফ্রন্টে। পশ্চিমে পঞ্জাব এব‌ং সিন্ধু প্রদেশ, অন্য দিকে পূর্বে ঢাকা, শ্রীহট্ট এবং চট্টগ্রাম জেলা দিয়ে।’

একই ভাবে ইন্দিরা-পুত্রের রাজনৈতিক জীবনেরও একটি অধ্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন অশোক। সময়টা ১৯৮৭ সালের জুলাই মাস। ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তিচুক্তি সই হওয়ার ঠিক এক দিন আগে। এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরনকে নয়াদিল্লি নিয়ে আসা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর সঙ্গে বৈঠক করানোর জন্য। প্রভাকরনকে রাখা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে। রাতে প্রভাকরনকে চুক্তির প্রতিলিপিটি দেখালেন রাজীব। মুথ থমথমে হয়ে গেল তাঁর। কাগজটি রাজীবের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা মানা সম্ভব নয়। অনেক অনুরোধ, চাপ, ভয়— গলল না বরফ। অগত্যা রাজীব নিরাপত্তা অফিসারদের বলে দিলেন পর দিন ভোরেই প্রভাকরনকে দেশে ফেরত পাঠাতে। অশোক লিখছেন, ‘ঠিক সে সময়ই প্রভাকরন বেঁকে বসেন এবং জে পি-র সঙ্গে সেই মাঝরাতেই দেখা করতে চান। হুমকি দেন, যদি তাঁকে নিয়ে না যাওয়া হয়, তা হলে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধর্নায় বসবেন। রাত ১টার সময় জে পি বারান্দা থেকে দেখেন প্রভাকরন তাঁর বাড়ির সামনে! সঙ্গে নিরাপত্তা অফিসারদের বিরাট বাহিনী। নিজে হাতে কফি বানিয়ে প্রভাকরনের মুখোমুখি বসেন। সব ঘটনা খুলে বলে প্রভাকরন সে দিন জে পি-কে বলেছিলেন, যদি আপনাদের প্রধানমন্ত্রীর খারাপ কিছু ঘটে যায় আমাদের (এলটিটিই) কে দায়ী করতে পারবেন না।’

পর দিন ভোরেই ফোন করে রাজীবকে সব কথা বলেন জে পি। শান্তিচুক্তি সই করতে তখনই কলম্বো যেতে নিষেধও করেন। অশোক লিখছেন, রাজীবও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন প্রথমে। কিন্তু দশ মিনিট পরই তিনি জে পি-কে পালটা ফোন করে জানান, উপদেষ্টারা একমত হয়েছেন যে কলম্বো গিয়ে চুক্তির কাজ সম্পন্ন করা উচিত। এর পরই বিমান ধরেন রাজীব।

এই ঘটনার বর্ণনা শেষ করেছেন অশোক পার্থসারথি— ‘বাকিটা ইতিহাসে লেখা রয়েছে!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indira Gandhi Rajiv Gandhi Pakistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE