Advertisement
E-Paper

হরিমাধবকে চিনি কি না, জানতে চেয়েছিলেন একজন

‘চিরকুমার সভা’ দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘গলায় সুর আছে, গানটা একটু চর্চা করলেই তো হয়!’’ লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়‘চিরকুমার সভা’ দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘গলায় সুর আছে, গানটা একটু চর্চা করলেই তো হয়!’’ লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:১৩
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আই এস জোহর দু’টি সংখ্যায় ‘দ্য জুলফি মাই ফ্রেন্ড’ বলে একটা নাটক লিখেছিলেন। তিনি জুলফিকার আলি ভুট্টোর বন্ধু ছিলেন। দু’জন এক সঙ্গে হার্ভার্ডে পড়েছেন। খুব নামকরা একটি পত্রিকার তিনি এক সময় সম্পাদনা করতেন। পরবর্তী কালে চিত্রাভিনেতা হয়ে যান। নাটকটি যখন টেলিগ্রাফে প্রথম বেরোয়, তখন আমার চোখে পড়েনি। পরে অভিজিৎ সেন আমাকে নাটকটা পড়তে বলে। পড়ে দেখলাম অসাধারণ নাটক!

নাটকের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে— জননেতাদের ধারণা হয় যে, জনতা তাঁদের কেনা বস্তু, জনতা তাঁদের কথায় উঠবে-বসবে। আসলে, জনতা কারও কেনা নয়, সেটা ভুট্টো একটা সময়ের পর বুঝতে পারে। তাই নাটকের শেষে সে বলে, ‘‘আজ পর্যন্ত জনতাকে যারা বিশ্বাস করেছে, তারা হচ্ছে সব চেয়ে বড় মূর্খ। জনতা কাউকে ক্ষমা করে না, আমাকেও ক্ষমা করেনি।’’ এই ধারণাটা আমার দারুণ লেগেছিল। এই ভাবনাকে মাথায় রেখে ‘স্বখাত সলিল’ নাটকটি আমি লিখি। নাটকটি প্রযোজনার কথা মাথায় রেখে আমি ভুট্টোর মতো দেখতে একটা লোকও জোগাড় করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর করা হয়নি।

যাই হোক, একদিন ফ্রিডরিক ড্যুরান মাটের একটা একাঙ্ক নাটকের সংগ্রহ আমার হাতে পড়ে। সেই নাটকগুলো আমার আগে পড়া ছিল না। হঠাৎ তার ভিতর থেকে ছোট একটা নাটক আমি পড়ে ফেলি— ‘ইনসিডেন্ট অব আ টুইলাইট’। নাটকটা পড়ে এত ভাল লাগে যে, আমি নাটকটিকে এ দেশের প্রেক্ষাপটে নিজের মতো করে লেখার কথা ভাবি। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। কয়েক দিনের মধ্যেই ‘গোধূলি বেলায়’ নামে একাঙ্ক নাটক লিখি। নাটকটি পরে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর অমর গঙ্গোপাধ্যায় নাটকটি কলকাতা দূরদর্শনে অভিনয় করার জন্য আমার কাছ থেকে অনুমতি নেন। পরে অবশ্য দূরদর্শনে নাটকটি সম্প্রচারিত হয়।

স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের গল্প অবলম্বনে আমি ‘মন্ত্রশক্তি’ নাটকটা লিখি। গল্পটার কেন্দ্রে ছিল তেভাগা আন্দোলন, যা বৃহত্তর অর্থে কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলন এক সময় গড়ে উঠেছিল মূলত দক্ষিণবঙ্গে এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে উত্তরবঙ্গেও বটে। আমার এই নাটকের কাহিনি ছিল উত্তরবঙ্গের একটি অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, যা একসময় জোরদার হয়ে উঠেছিল। এমন জোরাল হয়ে উঠেছিল যে, পুলিশ বাহিনীও পরাস্ত হয়েছিল। জনৈক সামসেরের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ওই অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এমনকি, এই সামসেরকে খুঁজে বার করতে পুলিশ কর্তারা ল্যাজেগোবরে হয়ে যান। নাটকের শেষে বোঝা যায়, সামসের বলে কেউ কোনও দিনই ছিল না। সমগ্র আন্দোলনটি পরিচালনা করেছিলেন এক সাধারণ রমণী, সামসেরের আড়ালে যার নাম যশোদা বর্মণ। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এখানকার দারোগা নিখিল চক্রবর্তীর কাছে তেভাগা আন্দোলনের বিচিত্র ঘটনা এবং যাবতীয় অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম। নাটকটি লেখার সময় সেগুলো নানা ভাবে ব্যবহার করি এবং যশোদা বর্মণ নামে চরিত্রটিও নাটকে রাখি। বাস্তবে যশোদা বর্মণ গুলি খেয়ে মারা যান। কিন্তু নাটকে যশোদা বর্মণ অপরাজেয় সংগ্রামের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।

আমি ‘চিরকুমার সভা’ যখন করি, তখন এক ঘটনা ঘটে। একদিন বাসে করে বালুরঘাট থেকে কলকাতা যাচ্ছি। আমার পাশে এক ভদ্রলোক, তাঁকে আমি চিনতাম, এখানে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিংয়ে মিউজিকের টিচার ছিলেন, ভাল গান জানতেন। আমার পাশেই বসে আছেন, হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি বালুরঘাটে থাকেন?’’ বললাম, হ্যাঁ। কী করেন-টরেন জিগ্যেস করলেন। আমি ওই হ্যাঁ-হু তেমন কিছু না বলে পাশ কাটাচ্ছি। তারপর বললেন, ‘‘আমি ত্রিতীর্থের একটা নাটক দেখলাম সেদিন। ‘দেবীগর্জন’! বাপ রে! সে তো দারুন ব্যাপার! ওই ভদ্রলোক প্রভঞ্জন করছিলেন, কী যেন নাম, হরিমাধব না কী! কী দারুণ করলেন!’’ এইসব বলছেন-টলছেন। আমাকে বললেন, ‘‘দেখেছেন?’’ আমি জানালাম, দেখেছি। পুনরায় বললেন, ‘‘লোকটাকে চেনেন নাকি? শুনেছি, কলেজে পড়ান।’’ জানালাম, চিনি না, আমিও শুনেছি।

এর পর কৃষ্ণনগরে একটি ধাবায় বাস দাঁড়িয়েছে, আমি নেমে আমার মতো করে চা খাচ্ছি। তখন বালুরঘাটের অন্য আর একটি বাস থামল, তাতে চেনা একজন লোক ছিল। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘‘এই মাধবদা, কোথায় যাচ্ছেন?’’ ডাকতেই আমি তখন স্বাভাবিক ভাবেই সাড়া দিয়েছি। তখন ভদ্রলোক আমাকে ধরেছেন, ‘‘আচ্ছা আপনাকে ওই লোকটা কী বলে যেন ডাকলেন?’’ আর যাই কোথা! বললেন, "আমাকে আপনি এইরকম বোকা বানালেন!’’

কিছুদিন পর ভদ্রলোক আমার নতুন কাজ ‘চিরকুমার সভা’ দেখতে এলেন। দেখার পর রাস্তায় আমাকে ধরেন। সোজাসাপ্টা করে বললেন, ‘‘স্টেজে উঠে ফাজলামি করেন নাকি? ভাবেন, সবাই যারা দেখতে এসেছে, তারা বোগদা?’’ আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কী বলে রে! তারপর বললেন, ‘‘গলায় সুর আছে, গানটা একটু চর্চা করলেই তো হয়!’’ আমি বললাম, ‘‘এই বয়েসে কি আর সে সব হয়?’’ তিনি বললেন, ‘‘ছাড়ুন মশাই, শেখার কোনও বয়স আছে নাকি! আপনাকে কিছু করতে হবে না, আমি এসে শিখিয়ে যাব। ভোলা চক্রবর্তীকে পয়সা দিয়ে ডেকে লোকে পায় না! বুঝলেন?’’

ভদ্রলোক প্রতিদিন রিকশ করে আসতেন, আমাকে সরগম শেখাতেন, তারপর আড্ডা দিয়ে চলে যেতেন। পাঁচ বছর ধরে তিনি আমায় শিখিয়েছেন, আমার গলা তৈরি করেছেন। যখন উনি রিটায়ার করে জলপাইগুড়িতে চলে যান, তখন ওদিকে নাটকের কাজে গেলেই ওঁর বাড়ি যেতাম। একদিন ওঁকে বললাম, "আমাকে তো মিউজিক কম্পোজিশনও করতে হয় নাটকের স্বার্থে, আপনি যদি আমাকে নোটেশনটা শেখান। আসলে আমি নিজে কখনও গান গাওয়া শিখিনি, তাই সেই অর্থে সঙ্গীতের ব্যাকরণ শিখিনি। কিন্তু আমি একটা সঙ্গীতের আবহ ও পরম্পরার মধ্যে বড় হয়েছি। আমার বাবা ছিলেন পেশাদার কীর্তন গাইয়ে। বছরের বেশির ভাগ সময়টাই তিনি বাইরে বাইরে কীর্তন গাইতে যেতেন। আর বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানের আসর বসত।’’

তিনি সেদিন আমাকে কী ভাবে নোটেশন তৈরি করতে হয়, শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Hari Madhab Mukhopadhyay Theatre
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy