Advertisement
E-Paper

জৈব চাষের পথে বাধা অনেক

চাষিরা গোবর, গোমূত্র, চিটে গুড়, নিমপাতা, কালমেঘ, কাঁচালঙ্কা দিয়ে জৈব সার ও কীটনাশক তৈরি করতে শিখলেন। তাতে চাষের খরচও কমল। রাসায়নিক সারে এক বিঘে জমিতে পান চাষ করতে খরচ দশ হাজার টাকা। জৈব সারে আড়াই হাজার টাকা। বিঘে প্রতি ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা বাড়তি লাভ।

বিশ্বনাথ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৭ ১২:৩০

জৈব চাষ করে যাঁরা সফল, দেশের এমন ৩৯ জন চাষিকে সম্প্রতি কৃষকরত্ন পুরস্কার দিল বেঙ্গালুরুর একটি কৃষিবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। উপস্থিত ছিলেন মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটকের কৃষিমন্ত্রী ও আধিকারিকরা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে দেখা গেল সকলেই বলছেন, জৈব বিনে চাষের গতি নেই। কথাগুলো নতুন নয়। মাটির স্বাস্থ্য বজায় রেখে, পরিবেশ বাঁচিয়ে, মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করে কী করে চাষ করা যায়, তার উত্তর জৈব চাষ। জৈব চাষ বাড়াতে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার।

কিন্তু বাস্তবে দেখছি, যে চাষিরা জৈব চাষ করছেন, তাঁদের প্রতি ধাপে ধাক্কা খেতে হচ্ছে। মনোবল ভেঙে যাচ্ছে চাষিদের।

নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা করিমপুর ও লাগোয়া এলাকায় পান, তরিতরকারি, কলা, ধান এমনকী গমও জৈব সার ও কীটনাশকে চাষ হচ্ছে। ২০১২ সালে নদিয়ায় সাতটি ‘জৈব গ্রাম’ও তৈরি করা হয়। এই গ্রামগুলিতে রাসায়নিক সার ঢুকতেই পারে না। রাজ্যে এমন নজির খুব বেশি নেই। এই উদ্যোগের শুরুটা হয়েছিল আর্থিক ক্ষতির ধাক্কায়। এই অঞ্চলে পান হল প্রধান অর্থকরী ফসল। ২০০৩ সালে প্রায় বারোশো হেক্টর জমিতে তীব্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় পান চাষ। কয়েক জন চাষি আত্মহত্যাও করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থার প্রতিনিধিরা মাটি পরীক্ষা করে জানান, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলেই এই বিপত্তি। তাঁরা জৈব চাষ শুরুর পরামর্শ দেন। এর পর মেদিনীপুর থেকে নদিয়ার কিছু চাষি গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে এলাকার চাষিদের শেখান। উৎসাহ দেন তৎকালীন করিমপুর ২ বিডিও স্বপন কুণ্ডু।

চাষিরা গোবর, গোমূত্র, চিটে গুড়, নিমপাতা, কালমেঘ, কাঁচালঙ্কা দিয়ে জৈব সার ও কীটনাশক তৈরি করতে শিখলেন। তাতে চাষের খরচও কমল। রাসায়নিক সারে এক বিঘে জমিতে পান চাষ করতে খরচ দশ হাজার টাকা। জৈব সারে আড়াই হাজার টাকা। বিঘে প্রতি ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা বাড়তি লাভ। ঝলসার মতো রোগের আক্রমণ যে জৈব ফসল অনেক ভাল প্রতিরোধ করতে পারে, তারও প্রমাণ মিলেছে। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে সম্প্রতি বিঘার পর বিঘা গম ঝলসা-আক্রান্ত হয়, ফসল পুড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু মুরুটিয়া এলাকায় জৈব গম আক্রান্ত হয়নি, বরং ভাল ফলন হয়েছে।

অথচ জৈব চাষকে লাভজনক করতে সরকারের তরফে যা যা করার কথা ছিল, তার প্রায় কিছুই হয়নি। কথা ছিল, সরকার তৈরি করবে জৈব-বাজার, সেখানে চাষিরা সরাসরি বিক্রি করবেন। জৈব ফসলের দাম বেশি, তাই তার উপকারিতার বিষয়েও সরকারি প্রচারের কথা ছিল। সে কাজটি হয়নি। এলাকায় এখনও বেশি দাম দিয়ে জৈব ফসল কেনার ক্রেতা তৈরি হয়নি। সেখানে মুড়িমিছরির এক দর। আবার দূরের বাজারের সঙ্গে সংযোগও তৈরি হয়নি। মাঝেমধ্যে শিলিগুড়ি কিংবা কলকাতায় কিছু ফসল বিক্রি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সংযোগের ধারাবাহিকতা নেই বলে চাষ লাভজনক হচ্ছে না।

তিন বছর জৈব চাষ না করলে জৈব ফসলের শংসাপত্র দেয় না কেন্দ্রীয় সরকার। ওই শংসাপত্র পেলে তবেই বড় ব্যবসায়ী, শপিং মল, হোটেল-রেস্তোরাঁ ‘অর্গানিক’ ফল, সবজি বা ফসলের দাম দেন। অথচ জৈব চাষে পরিশ্রম বেশি, তাই চাষিরা অন্য কাজ থেকে রোজগারের সুযোগ পান না। তাই জৈব চাষ শুরু করার সময়ে কয়েক বছর চাষিদের আর্থিক সহায়তা জরুরি।

এখানে বলা দরকার, জৈব চাষিদের সহায়তার নানা প্রকল্প রয়েছে। ‘পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা’ শুরু হয় ২০১৫ সালে। এই পরিকল্পনার অধীনে জৈব চাষিদের টাকা, সার, বীজ, প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশনের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে ৪১২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। বেঙ্গালুরুতে জানা গেল, অন্য রাজ্যের চাষিরা ওই যোজনার সুযোগসুবিধে পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের রাজ্যে তা মিলছে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, গত বছর থেকে তা-ও পাননি চাষিরা।

ফলে যে চাষিরা বিস্তর ঝুঁকি নিয়ে জৈব চাষ শুরু করেছিলেন, তাঁরা পড়ছেন উভয়সংকটে। অনেক বিনিয়োগ করে জৈব চাষ শুরু করে এখন তাঁরা রাসায়নিক চাষে ফিরতে পারছেন না। আবার সরকারি সহায়তায় বাজার ধরতে না পারায় মিলছে না লাভের কড়ি। থমকে যাচ্ছে ব্লকে ব্লকে জৈব গ্রাম তৈরির লক্ষ্য।

সব থেকে বড় আক্ষেপের বিষয় হল এই যে, চাষিরা নিজেদের উদ্যোগে মাঝেমধ্যে সচেতনতা শিবির বা কর্মশালার আয়োজন করেন। সেখানে কৃষি দফতরের কর্তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তাঁদের বক্তৃতায় বড় জোর কুড়ি শতাংশ থাকে জৈব চাষের কথা। বাকি আশি শতাংশ রাসায়নিক সারের গুণগান। চাষিরা তাতে আরও ধন্দে পড়ে যান। জৈব চাষ করে কী হবে, এই প্রশ্নের উত্তর তখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

করিমপুর কৃষক সঙ্ঘের সম্পাদক

Agriculture Farmer Organic Farming জৈব চাষ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy