অতঃপর, ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’ স্লোগানটির প্রয়োজন ফুরাইল। শুধু আগমার্কা হিন্দুত্ববাদীরাই নহেন, জনসমক্ষে যাঁহারা নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ, উদার’ মানসিকতার প্রমাণ পেশ করিতে উদগ্রীব, তাঁহারাও প্রায় সকলেই নিশ্চিত— মন্দির কোথায় তৈরি হইবে, সে বিষয়ে আর সংশয় নাই। ‘ওইখানেই’ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইবে, ইহা অতএব আর প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা নহে, অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। ইহাই ক্ষমতার মাহাত্ম্য। মাত্র সাড়ে চার বৎসরে এমন জটিল একটি বিবাদের এ হেন সুষ্ঠু সমাধান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাভিন্ন হয় না। এখন একমাত্র প্রশ্ন, মন্দির নির্মাণ কবে হইবে? সুপ্রিম কোর্ট কী বলিল, জমির মালিকানা সংক্রান্ত মামলাটিকে আদালত অগ্রাধিকার দিতে রাজি হইল না কেন, এখন সব প্রশ্নই বাহুল্য। কারণ, ‘মানুষের ভাবাবেগ’ বলিয়াছে, রামলালার মন্দির ‘ওহি বনায়েঙ্গে’। রাম-সীতার মূর্তিটি যে নিতান্ত অর্বাচীন, ১৯৪৯ সালে মসজিদে জবরদস্তি প্রবেশ করিয়া তাহা স্থাপিত হইয়াছিল, গোরখনাথ মঠের সন্ত দিগ্বিজয় নাথের নেতৃত্বে নয় দিনের ‘রামচরিত মানস’ পাঠের পর, সেই তথ্যও একই রকম অবান্তর। কারণ সেই একই— মানুষের বিশ্বাস, রামলালা ঠিক ওইখানেই জন্মাইয়াছিলেন। সেই বিশ্বাসের সম্মুখে গবেষকদের নথির দাম টাকায় এক দামড়িও নহে। অযোধ্যাই যে রামের জন্মভূমি, এবং মসজিদের জমিটিতেই যে রামের আঁতুড়ঘর ছিল, এ হেন দাবিও বিশেষ প্রাচীন নহে। তাহার বয়স বড় জোর আড়াই শতক। বস্তুত, সিপাহি বিদ্রোহের কাছাকাছি সময়ের পূর্বে মসজিদ দখল করিয়া মন্দির গড়িবার দাবি কখনও শোনা গিয়াছিল কি না, তাহাতে বিস্তর সংশয় আছে।
সেই সংশয় গবেষকের, ভক্তদের নহে। রাম নামে আদৌ কেহ ছিলেন কি না, সে প্রশ্ন এখন অর্থহীন। হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে সরযূ নদীর তীরে সত্যই রাম নামক এক জন জন্মাইয়াছিলেন, কালেক্রমে দশানন রাবণকে বধ করিয়া সীতাকে ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন, অনতিবিলম্বে সন্দেহের বশে তাঁহাকে ঘোর অপমান করিয়া বিদায়ও করিয়াছিলেন— এই আখ্যানটিকে ইতিহাস বলিয়া মান্য করাই বিধেয়। কিন্তু, সেই সরযূ নদীর তীরটি কি অধুনা উত্তরপ্রদেশেই ছিল? নেপালে নহে, আফগানিস্তানেও নহে, মিশরে নহে, এমনকি ঘরের কাছে হরিয়ানাতেও নহে? রাম নামক চরিত্রটি যদি আদৌ বাস্তব হয়, তাহার জন্মভূমি কোথায়, তাহার অন্তত আটটি বিকল্পের কথা বলিয়াছেন ইতিহাসবিদরা। আদিত্যনাথ যতই ফৈজ়াবাদের নাম পাল্টাইয়া দিন, সম্ভাব্য জন্মভূমির তালিকায় অযোধ্যার দাবি ক্ষীণ। ১৫৭৪’এ অযোধ্যায় বসিয়াই ‘রামচরিত মানস’ লিখিলেন তুলসীদাস, অথচ জায়াগাটিকে হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্র হিসাবে উল্লেখ করিলেন না, এই ইতিহাসকে ভক্তরা পাল্টাইবেন কোন যুক্তিতে? কিন্তু, বিজেপির ভারত স্থির করিয়াছে ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’। ব্যস।
রামচন্দ্রের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব হইতে তাঁহার জন্মভূমি— সকলই বিশ্বাসমাত্র। কিন্তু, সেই বিশ্বাসকে আদিগন্ত জমি ছাড়িয়া দেওয়ার পরও একটি সত্য অনপনেয়: বাবরি মসজিদ নামক সৌধটির থাকা, ও না থাকা। মসজিদের নীচে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ ছিল কি না, মন্দির ভাঙিয়াই মসজিদ নির্মিত হইয়াছিল কি না— সকল প্রশ্ন ছাপাইয়া জাগিয়া থাকে সেই সত্য: অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অবধি ছিল। লালকৃষ্ণ আডবাণীরা দেড় লক্ষ করসেবক লইয়া অযোধ্যায় হানা দেওয়া অবধি ছিল। তাহার পর হইতে, নাই। তাহার চূড়ায় গৈরিক পতাকা উড়াইবার ছবিটি আছে, মসজিদের ভাঙিয়া প়ড়িবার শব্দ এখনও কানে বাজে। করসেবকদের উল্লাসের স্মৃতি আছে, কল্যাণ সিংহের সরকারের চর্চিত নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ আছে। শুধু মসজিদটি নাই। এই সত্যটিকে লইয়া ভারত কী করিবে? কী ভাবে সংশোধন করিবে সেই বর্বরতার ইতিহাস? ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নিকট বাবরি মসজিদের প্রধানতম তাৎপর্য তাহার অবলুপ্তিতেই। ধ্বংসের সেই মুহূর্তটি ছিল ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর পৈশাচিক আঘাত। সেই কলঙ্ক মুছিবার কোনও উপায় নাই। কিন্তু অন্তত প্রায়শ্চিত্ত আবশ্যক। তাহার একটিই পথ আছে: মসজিদটি ফের গড়িয়া দেওয়া। ক্ষমাপ্রার্থনার পর, ভুল স্বীকারের পর। অযোধ্যাতেই। ইহাই স্বাভাবিক ন্যায়ের দাবি। ন্যূনতম দাবি। গভীর দুঃখের কথা, উদ্বেগেরও, যে— এই দাবি বিশেষ কেহ উচ্চারণও করেন না। হিন্দুত্ববাদীরা করিবেন না, স্বাভাবিক। কিন্তু তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy