মাহেন্দ্রক্ষণ: অনেক হিংসা ও বিভেদ পেরিয়ে সে দিন সহসা অন্য ছবি এঁকেছিলেন মহানগরের মানুষ। কলকাতা, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭
ভারত এখন, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ভাষায়, এক ‘দুর্ভাগ্যজনক সময়পর্বের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন তার নিজেকে পুনরাবিষ্কার করা প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ অগস্ট মধ্যরাত্রির সেই মাহেন্দ্রক্ষণে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘যে যে ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই সমানভাবে ভারতের সন্তান, আমাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান দায়িত্ব আছে।’’— এই অঙ্গীকার রক্ষা করা তো দূরস্থান, ক্রমশ ভঙ্গ করা হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ভারতের অসাধারণ অভিযানের ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনা হবে সামনের পাঁচ বছরে— ২০১৭ থেকে ২০২২ হবে ‘সংকল্প’ থেকে ‘সিদ্ধি’-র পথে অভিযান। ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আজাদ হিন্দ ফৌজের সশস্ত্র লড়াইয়ের মতো বেশ কয়েকটি গৌরবময় সংগ্রাম অবশ্যই ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭-এর মধ্যে ঘটেছে। হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারীরা কিন্তু এই সব আন্দোলন বা লড়াইয়ে যোগ দেননি, সে জন্য কোনও আত্মত্যাগ করেননি। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর সময় ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করার যে শপথ নেওয়া হয়েছিল, গোলওয়ালকর পরিচালিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রবক্তারা তা সমর্থন করেননি। এবং, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি যখন ঘোষণা করেন ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবে, তখন হিন্দু মহাসভাই প্রথম পঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল।
স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যরাত্রিতে নেহরুর সেই ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’ (ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি) ভাষণ শুরু হয়েছিল একটি সৎ স্বীকারোক্তি দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতার অঙ্গীকার ‘সম্পূর্ণভাবে বা ষোলো আনা’ পূরণ করা হয়নি। কিন্তু তা ‘বহুলাংশে’ পূর্ণ হয়েছে— তাঁর এই দাবিও প্রশ্নাতীত নয়, কারণ স্বাধীনতার খুব বড় মূল্য দিতে হয়েছিল দেশভাগজনিত বিপুল ক্ষয়ক্ষতিতে, লক্ষ লক্ষ মানুষের অসীম দুর্দশায়। ‘স্বাধীনতার স্থপতি’ সম্পর্কেও আবেগময় উক্তি করে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘আমরা তাঁর অযোগ্য অনুগামী, তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছি।’’ মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার লগ্নে গাঁধীজির নীরবতা নেহরুর বাগ্মিতার চেয়ে অনেক বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল। দিল্লিতে স্বাধীনতার উদ্যাপনের আড়ম্বর থেকে গাঁধীজি তখন অনেক দূরে, কলকাতায়, এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর জাতির উদ্দেশে বার্তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে জাতির পিতা, কোনও দিন যাঁর কথার অভাব হয়নি, সে দিন বলেছিলেন, ‘‘আমার (কথা) শুকিয়ে গিয়েছে।’’
দেশ জুড়ে এখন এক অযুক্তি ও অমানবিকতার প্লাবন। আর তাই, আজ, স্বাধীনতার এই সত্তর বছর পূর্তিতে বুক বাজিয়ে উৎসব করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ভারতের আত্মার গভীরে গিয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করা। নেহরু নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাতের যে কাব্যময় মোহাবেশ তৈরি করেছিলেন, আজও কি আমরা তার কাছে ধরা দেব? অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স গ্রন্থের সাবটাইটল দিয়েছিলেন ইলিউশন অব ডেস্টিনি— নিয়তির মোহ। এটা ঠিকই, নিয়তিতে বিশ্বাস করলে অনেক সময় যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়, অস্বীকার করা হয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে। তার সঙ্গে এই ভয়ও থাকে যে, একটা জাতির জীবনে যে সব সমস্যা আসে, সেগুলির জন্য নিয়তিকে দায়ী করা হবে। তবে অমর্ত্য সেনের বইটি মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, তিনি মূলত একক বা একমাত্রিক সত্তা-র (সিঙ্গুলার আইডেন্টিটি) বিপদ নিয়েই বলতে চেয়েছেন, নিয়তি নিয়ে ততটা নয়। আজ আমাদের বুঝতে হবে, বহুমাত্রিক সত্তাকে স্বীকার ও গ্রহণ করা একটা নৈতিক কর্তব্য। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের যে আবেগ-নির্ভর শক্তি, কেবল বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে তার মোকাবিলা করা যাবে না, ভারতের শুভনিয়তির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থাকলেই তবে ভারতাত্মাকে উদ্ধারের লড়াইটা সার্থকভাবে চালানো সম্ভব হবে।
গাঁধীজির নৈতিকতার জোর এতটাই যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট কলকাতা শান্তিপূর্ণ ছিল। অগস্টের ১৬ তারিখ, কলকাতায় ছেচল্লিশের দাঙ্গার এক বছর পূর্তিতে গাঁধীজি একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘অলৌকিক ঘটনা না দুর্ঘটনা’ নামের সেই লেখায় তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা দিবসে কী ভাবে হিন্দু ও মুসলমানরা সমস্বরে ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি তুলেছিল। সেটা কোনও অলৌকিক ঘটনা ছিল না, দুর্ঘটনাও ছিল না। আসলে সে দিন ঈশ্বরের সংগীতে মানুষ সাড়া দিয়েছিল। গাঁধীজি আরও লিখেছিলেন, ‘‘আমরা পারস্পরিক ঘৃণার গরল পান করেছি, তাই ভ্রাতৃত্বের অমৃত এত মধুর লাগে। এই মধুরতা যেন কোনও দিন হারিয়ে না যায়।’’
১৯৪৭-এর অগস্ট মাসের শেষের দিকে কলকাতায় ফের দাঙ্গা লাগল, ১ সেপ্টেম্বর গাঁধীজি অনশন শুরু করলেন। রাজাগোপালাচারী তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ওই গুন্ডাদের জন্য আপনি অনশন করছেন?’’ গাঁধীজি উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘এই গুন্ডাদের আমরাই তৈরি করেছি।’’
দেশের সমকালীন সংকটের প্রেক্ষিতে গাঁধীজির জীবনের শেষ সাড়ে পাঁচ মাসের ইতিহাস খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁর অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা বোঝা যায় যখন তিনি বলেন, ‘অ-ধর্মই ধর্মের মুখোশ পরেছে।’ দেশের সরকার ও শাসক দলের দায়িত্ব কতখানি, ১৯৪৭ সালের ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের প্রথম এআইসিসি অধিবেশনে সে বিষয়ে গাঁধীজি তাঁর স্পষ্ট অভিমত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের এক জন মুসলমানও যেন জীবনের নিরাপত্তার অভাব বোধ না করেন।’ তাঁর জীবনের শেষ অনশন শুরু হয় ১২ জানুয়ারি ১৯৪৮, এই কথাটা বোঝাতে যে, কোনও ভারতবাসী যেন মনে না করেন, ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ এবং সংখ্যালঘুরা এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
গাঁধীজি সচরাচর কারও জন্মদিন ‘মনে রাখতে পারতেন না’, কিন্তু ১৯৪৮-এর ২৩ জানুয়ারি, তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে, সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন মনে রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘সুভাষ কোনও প্রাদেশিকতায় বিশ্বাস করতেন না, তাঁর কোনও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিও ছিল না। সারা ভারতের নানা ধর্মের পুরুষ ও মহিলারা কোনও ভেদাভেদ মনে না রেখে তাঁর ফৌজে যোগদান করেছিলেন। এবং তিনি তাঁদের মধ্যে প্রীতি ও বিশ্বস্ততা জাগিয়ে তুলেছিলেন, যা খুব কম লোক পারেন।’ সুভাষচন্দ্রের মতো ‘মহান দেশপ্রেমী’র দৃষ্টান্ত সামনে রেখে তিনি ভারতবাসীকে বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার কলুষ মন থেকে মুছে ফেলতে হবে।’ অথচ সুভাষ বসু ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষপাতী আর গাঁধীজি অহিংসায় বিশ্বাসী!
বিপুল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ছায়া অনেক সময়েই কেন্দ্রের সঙ্গে প্রদেশগুলির সম্পর্ককে আচ্ছন্ন করেছে, যার বড় রকমের প্রভাব পড়েছে ভারত তথা পঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের সিদ্ধান্তে। দেশভাগের মূল্য চুকিয়েই ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজ-এর কেন্দ্রীভূত শাসনযন্ত্রটি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করে, যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একক সার্বভৌমত্বের ধারণা। প্রথমে এই কেন্দ্রীয়তা ধর্মনিরপেক্ষতার (ও সমাজতন্ত্রের) রূপ ধারণ করে, সাম্প্রতিক কালে তা গেরুয়া পোশাক পরেছে। দেশের মধ্যে ভাষা, প্রদেশ এবং ধর্মের যে বিরাট বৈচিত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐক্যের ধারণায় তাকে সসম্মান স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দেশের সমৃদ্ধতম রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার এক সাধারণ ধর্ম। ১৯২৮ সালে মহারাষ্ট্র পলিটিকাল কনফারেন্স-এ প্রদত্ত ভাষণে সুভাষচন্দ্র বসু দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ‘সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা’র কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের ভারতকে একটি ‘স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সেই আদর্শকে ১৯৪৭ সালে এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। ২০১৭ সালে ধর্মভিত্তিক সংখ্যাগুরুবাদের বিকল্প হিসেবে তা এক নতুন গুরুত্ব অর্জন করেছে।
অতীত এবং ভবিষ্যৎ, পুরনো এবং নতুনের সম্পর্ক নিয়ে ভাবার পক্ষে স্বাধীনতার সত্তর বছর হয়তো বেশ উপযুক্ত সময়। ২০১৭ সালে নেহরুর চেয়ারে যিনি আসীন, তিনি ‘এক নতুন ভারত’-এর কথা বলছেন। কথাটা নিতান্ত অন্তঃসারশূন্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘‘আর নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটীর ভেদ করে, জেলে, মালা, মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে।’’ তাঁর সাম্যের বাণী শ্রেণির গণ্ডি ছাড়িয়ে লিঙ্গ এবং জাতিবর্ণের স্তরেও প্রসারিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারতের দুই মহাপাপ— মেয়েদের পায়ে দলানো, আর জাতি জাতি করে গরীবগুলোকে পিষে ফেলা।’’ ধর্মীয় সমন্বয়ের গভীর বোধ থেকেই উৎসারিত হয়েছিল শিকাগো ধর্মমহাসভায় তাঁর ভাষণ: ‘‘শুধু এই নয় যে, আমরা বিশ্বজনীন সহিষ্ণুতায় বিশ্বাস করি, আমরা সমস্ত ধর্মমতকে সত্য বলে স্বীকার করি।’’ ভারতের প্রেক্ষিতে সমন্বয়ের রূপ কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে তাঁর নিজস্ব সুচিন্তিত মত ছিল। তাঁর লেখায় পড়ি, ‘‘আমার দৃঢ় ধারণা, বেদান্তের তত্ত্ব যত সূক্ষ্ম এবং অপূর্বই হোক, ফলিত ইসলামের সাহায্য ছাড়া বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের জীবনে তার কোনও মূল্য নেই।’’ তার কারণ, ‘‘কোনও ধর্মমত যদি (মানুষে মানুষে) এই সাম্যের প্রতি যথার্থ মনোযোগী হয়ে থাকে, তা হল ইসলাম।’’
প্রাচীন ভারত সম্পর্কে বিবেকানন্দের ধারণায় যে ভারসাম্য ছিল, আজ যাঁরা দেশের অতীত গৌরব উদ্ধারে ব্যগ্র, তাঁরা সেটি বোঝার চেষ্টা করলে ভাল করবেন। তাঁর মতে, ‘‘প্রাচীনকালে ঢের ভাল জিনিস ছিল, খারাপ জিনিসও ছিল। ভালগুলি রাখতে হবে, কিন্তু আসছে যে ভারত— Future India— Ancient India-র অপেক্ষা অনেক বড়ো হবে।’’
অতীতের অশুভ উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হওয়া সহজ নয়। ১৮৯০-এর দশকে বিভিন্ন গোরক্ষা আন্দোলনে এবং ১৯২০-র দশকের শেষের দিকে শুদ্ধি ও সংগঠন আন্দোলনগুলিতে যে ঘৃণা প্রকট হয়েছিল, এখন গোরক্ষার নামে তার পুনরুত্থান হয়েছে। ঠিক একশো বছর আগে, ১৯১৭ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম গ্রন্থের একটি অনুচ্ছেদ পড়লে ২০১৭ সালের ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের এমন একটা পূর্বাভাস শোনা যায় যে গা ছমছম করে! তিনি বলেছিলেন, ‘‘সমাজের যে মানুষেরা বিভিন্ন বিষয়ে, এমনকি খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয়ে আমাদের থেকে আলাদা, যে মানসিকতার বশে আমরা তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলি, সেটা আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনেও প্রভাব ফেলবে, এবং যে যুক্তিসংগত বিভিন্নতা জীবনের লক্ষণ, তাকে সমস্ত ক্ষেত্রে বিনাশ করতে চাইবে। এবং এই স্বৈর-আধিপত্য আমাদের রাজনৈতিক জীবনে অনিবার্য ভাবে মিথ্যা ও শঠতাকে ডেকে আনবে।’’
যুক্তিসংগত বিভিন্নতার প্রকাশ যখন প্রচণ্ড ভাবে আক্রান্ত হয়, তখন শুভ পরিণতিতে বিশ্বাসই আমাদের গভীর নৈরাশ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের যে গানটিকে আমরা জাতীয়সংগীত রূপে গ্রহণ করেছি, সেখানে দেশ এবং দেশবাসীর প্রতি অসীম আশীর্বাদ বর্ষণের জন্য ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র জয়ধ্বনি ঘোষিত হয়েছে। এই আশীর্বাদ বহুমাত্রিক— যিনি জনগণমঙ্গলদায়ক, তিনিই আবার জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক, যিনি ভারতের বহুধাবিচিত্র ধর্মীয় ও প্রাদেশিক বিভিন্নতার মধ্যে থেকে ঐক্যবিধান করেছেন। সেই জনগণদুঃখত্রায়ক’কে কবি দেখেছেন নারী রূপে, তাঁর উদ্দেশে বলেছেন তিনি: ‘ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে/ জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।/ দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে/ স্নেহময়ী তুমি মাতা।’
সাতচল্লিশের সেই মধ্যরাত্রিতে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘নির্ধারিত দিনটি সমাগত, নিয়তির নির্ধারিত এই দিন, এবং দীর্ঘ নিদ্রা ও সংগ্রামের শেষে ভারত আবার উঠে দাঁড়িয়েছে— জাগ্রত, সপ্রাণ, মুক্ত এবং স্বাধীন ভারত।’’ ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ কি নিয়তিনির্ধারিত দিন ছিল? কেবল যুক্তি দিয়ে বিচার করলে বলতে হবে, না, তা নয়। এই দিনটি কি লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্থির করেননি— সেই শেষ বড়লাট, যিনি ব্রিটিশ স্বার্থের যথাসম্ভব কম হানি করে যত দ্রুত সম্ভব ভারত ছাড়ার ব্যবস্থা করতে ব্যগ্র ছিলেন? কিন্তু তার পাশাপাশি এ কথাও তো মনে রাখতে হবে যে তার ঠিক দু’বছর আগে, ১৫ অগস্ট ১৯৪৫ সুভাষচন্দ্র বসু একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে যাঁরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, সেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে শেষ নির্দেশিকায় নেতাজি বলেছিলেন, “একটি মুহূর্তের জন্যও ভারতের শুভনিয়তিতে তোমাদের বিশ্বাস যেন না টলে। ভারত স্বাধীন হবে, এবং তার আর দেরি নেই।’’
মোদী যখন বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং লোকসভার অধ্যক্ষ, সবাই একই আদর্শে বিশ্বাসী, তাই পরের পাঁচ বছর হবে ভারতের রূপান্তরের কাল, তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তাঁর ‘সংকল্প’। ভারতের যথার্থ ধারণাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তাঁর এই সংকল্পকে ‘সিদ্ধি’ লাভ করতে দেওয়া চলে না। বর্তমান শাসকরা একটি সম্প্রদায় এবং একটি ভাষার যে অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, তার বিপরীতে নতুন ভারতের বিকল্প ধারণাটিকে সংস্থাপন করাই আমাদের কর্তব্য, সেই নতুন ভারতের প্রাণশক্তি হবে দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক সমন্বয় ও সুসম্পর্ক। ভারতাত্মার জন্য লড়াইয়ের একটা অংশ লড়তে হবে ধারণার পরিসরে, রাজনীতির রণক্ষেত্রে নয়। নেহরু সেই মধ্যরাতে যে অঙ্গীকার করেছিলেন, ভারতের নাগরিকদের আজ তা নতুন করে স্বীকার করতে হবে, বলতে হবে: ভারতের প্রতি, আমাদের পরম ভালবাসার মাতৃভূমির প্রতি, সুপ্রাচীন, শাশ্বত এবং চিরনবীন (স্বদেশের) প্রতি আমরা সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই এবং তাঁর সেবায় নিজেদের নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করি। জয় হিন্দ।— জয় হিন্দ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy