Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

তিনটি কাজ, পুরসভা যা করতেই পারে

কলকাতা শহরের উন্নতির জন্য অনেক বড় বড় পরিকল্পনার কথা আমরা শুনি। কিন্তু কয়েকটি প্রাথমিক কাজ আছে, যা করতে পারলেই অনেক দূর যাওয়া যায়। নাকের ডগায় চশমা আটকে পদস্থ সরকারি আমলাটি একটি ফুলস্ক্যাপ কাগজের এক দিকে চোখ বোলাচ্ছিলেন। সামনে গিয়ে বসতেই কাগজটা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে ফাইলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ৩০ বছর ধরে রিপোর্টারের কাজের অভিজ্ঞতায় মনে হল ওই কাগজটার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

কলকাতা শহরের উন্নতির জন্য অনেক বড় বড় পরিকল্পনার কথা আমরা শুনি। কিন্তু কয়েকটি প্রাথমিক কাজ আছে, যা করতে পারলেই অনেক দূর যাওয়া যায়। নাকের ডগায় চশমা আটকে পদস্থ সরকারি আমলাটি একটি ফুলস্ক্যাপ কাগজের এক দিকে চোখ বোলাচ্ছিলেন। সামনে গিয়ে বসতেই কাগজটা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে ফাইলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ৩০ বছর ধরে রিপোর্টারের কাজের অভিজ্ঞতায় মনে হল ওই কাগজটার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর। তাই এ কথা, সে কথার মধ্যে বার বার কাগজটির প্রসঙ্গ টেনে আনতে শুরু করলাম। এক সময়ে বিরক্ত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ আমলাটি সেটি আমার হাতে তুলেই দিলেন। দেখলাম এক পাতা নয়। চার পাতার একটি দলিল।

পড়তে শুরু করলাম। সবুজ কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে একটা তালিকা লেখা রয়েছে সেটিতে। কীসের তালিকা? কার কার পদোন্নতি বা বদলি হবে তার তালিকা? না। কোথায় কোথায় তদন্তে যাবে বাহিনী, তার তালিকা? তা-ও নয়। তা হলে? ওই তালিকাটি আসলে কয়েকটি সুপারিশের। কলকাতা পুরসভার নতুন বোর্ড বসলে তাদের কাছে সুপারিশ। মহানগরীকে পরিবেশ-বান্ধব করে তুলতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তার সুপারিশ। একসঙ্গে অনেকগুলি নয়। মাত্র তিনটি। যেগুলি রূপায়ণ করার জন্য পুরসভাকে এক পয়সাও খরচ করতে হবে না।

তা হলে ওই কাগজটা নিয়ে এত গোপনীয়তা কীসের? কেন্দ্রীয় সরকারের একটি আঞ্চলিক দফতরের কর্তাটি জানালেন, এই ঝাঁ চকচকে চেম্বারে বসে এ সব করছি জেনে আমি তাঁকে পাগল মনে করতে পারি। বললেন, এমন অভিজ্ঞতা নাকি তাঁর রয়েছে।

কলকাতার পরিবেশ উন্নয়নে কী কী সুপারিশ নতুন পুরবোর্ডকে করতে চান ওই আমলা?

বন্ধ হোক প্লাস্টিক

তাঁর প্রথম সুপারিশ: কলকাতা শহরে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারণ যত নষ্টের গোড়া ওই প্লাস্টিক। তার জন্য আটকে যাচ্ছে নিকাশি নালার মুখ। বর্ষার সময়ে জল জমে থাকছে। জমা জল থেকে ছড়াচ্ছে অসুখবিসুখ। এই পদার্থটি বায়ো-ননডিগ্রেডেবল, অর্থাৎ মাটির নীচে থাকতে থাকতে তা কখনওই মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। মাটির নীচে যে সব ব্যাক্টিরিয়া রয়েছে সেগুলি সহজে প্লাস্টিক হজম করতে পারে না। এ এক বড় সমস্যা। একটি সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে ফোম-প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করি সেগুলি মাটিতে কিংবা জলে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে আনুমানিক ৫০ বছর সময় নেয়। আর ওই ৫০ বছর ধরে ফোম-প্লাস্টিক কাপ পরিবেশকে দূষিত করে চলে।

সমুদ্রের জলে যদি কোথাও প্লাস্টিকের জাল আটকে থাকে, তা হলে ৬০০ বছর পর্যন্ত তা অক্ষয় হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে সমুদ্রে যে সব প্লাস্টিক জমা হয় সেগুলি রোদে, জলে এবং নানা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় বটে, কিন্তু সেই ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার সময়ে প্লাস্টিক থেকে বিসফেনল এ নামের এমন একটি পদার্থ নিঃসৃত হয় যা পরিবেশকে যারপরনাই দূষিত করে। ওই পদার্থটি মানুষ, গাছপালা কিংবা অন্য প্রাণীর শরীরে ঢুকলে বিভিন্ন কোষের ক্ষয় ঘটায়। আবার, প্লাস্টিক যে আপনি পুড়িয়ে ফেলবেন সেই উপায়-ও নেই। কারণ, প্লাস্টিক পুড়লে যে সব গ্যাস পরিবেশে মিশে যাচ্ছে তার সব ক’টিই মানুষের শরীরের পক্ষে হানিকর।

এই সুপারিশের নীচে একটি ফুটনোটে ওই আমলা লিখেছেন, স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু প্লাস্টিক যে সব কিছু অস্বচ্ছ করে দিচ্ছে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এতটুকুও ভাবছে না। আসলে পরিবেশ বিষয়টি কী কেন্দ্র, কী রাজ্য, সবার গুরুত্বের তালিকায় একেবারে তলার দিকে। পরিবেশ দূষণ, আবহওয়ার পরিবর্তন, যথাযথ জীববৈচিত্রের সংরক্ষণের বিষয়গুলি যতক্ষণ না গুরুত্বের দিক থেকে অগ্রাধিকার পাচ্ছে ততক্ষণ স্বচ্ছ ভারতের মতো প্রকল্প নিয়ে বড় বড় কথা বলে লাভ নেই।

ফুটনোটটিতে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের গয়ংগচ্ছ মনোভাবকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন ওই আমলা। লিখেছেন, প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকার নির্দেশিকা জারি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সেখানকার পুরসভা। কলকাতা সংলগ্ন একটি পুরসভার একটি ওয়ার্ডেও বাসিন্দারা বহু দিন ধরেই প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু বড় পুরসভাগুলিতে প্লাস্টিক বন্ধের কোনও উদ্যোগই সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলি নেয়নি। এই সরকারি আধিকারিক মনে করেন, স্বচ্ছ ভারত অভিযানের পরিকল্পনা ছকার আগে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্লাস্টিক ব্যাগ, প্লাস্টিকের মাছের জাল, প্লাস্টিকের কাপ তৈরি করা ও তা বিক্রি বন্ধে কড়া আইন প্রয়োগ করা উচিত ছিল।

ওই আমলার আশা, বড় শহরগুলির মধ্যে কলকাতা এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।

গাছের গায়ে আলোকসজ্জা

দ্বিতীয় সুপারিশ: কলকাতায় বিভিন্ন গাছে টুনি এবং টিউব লাইট লগিয়ে যে সাজানোর রীতি শুরু হয়েছে তা বন্ধ হওয়া দরকার। কেন? ওই আলো থেকে যে প্রতিফলন হয় তাতে গাছে যে সব পাখি কিংবা অন্য জীব থাকে তাদের জৈব ঘড়ির (বায়োলজিক্যাল ক্লক) সময় বিন্যাসে সমস্যা হয়। যা ওই সব পাখি ও অন্য প্রাণির স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাস্তুতন্ত্রের (ইকোসিস্টেম) ভারসাম্য এর ফলে নষ্ট হয়। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সেই এলাকার জীববৈচিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শর্ট সার্কিট হলে সব পাখি ও অন্য প্রাণির জীবনহানির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে।

শুধু কলকাতা কেন, গ্রামাঞ্চলে, বিভিন্ন সরকারি ভবনের মধ্যে থাকা গাছের গায়ে যে ভাবে আলোর মালা ঝোলানো হচ্ছে তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোন উপকার হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আমলাটি।

সুপারিশের নীচে ফুটনোটে ওই আমলা লিখেছেন, শুধু ঝাঁটা হাতে নিয়ে রাস্তাঘাট, অফিস-কাছা়রি পরিষ্কার করলেই কিন্তু ভারত স্বচ্ছ হবে না। যে বাতাস আমরা প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে চালান করি তাকে শুদ্ধ হতে হবে। আর তার জন্য গাছের জৈব ঘড়ির ছন্দ যাতে কোনও ভাবেই ব্যাহত না হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট তুলে ধরে ওই আমলা লিখেছেন, প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকারকে তাদের বিভিন্ন ভবনে গাছে আলোক সজ্জা বন্ধ করতে হবে। তার পরে আইন প্রণয়ন করতে হবে। ওই আমলাটি চান, কলকাতা পুরসভা এ ব্যাপারে দেশের পথিকৃৎ হোক।

এ ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা বোঝাতে আমলাটি নিজের একটি অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন নোটে। লিখেছেন, ‘‘একটি গাছ একটি প্রাণ সংক্রান্ত একটি পরিবেশবান্ধব অনুষ্ঠানে আমি অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। গাছেদের সম্মানে একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। দিনের আলো পড়ে আসতেই দেখি, রাজ্য সরকারের ওই অতিথিশালার বাগানে সব ক’টি গাছ আলোর মালা পরে হাসছে। আমার ওই হাসিকে বিদ্রুপ বলে মনে হচ্ছিল। অনুষ্ঠান থেকে দ্রুত পালিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম আমি। পরে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা রাজ্যের এক পদস্থ আমলাকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। পরে শুনেছি তাঁর সহকর্মীদের কাছে আমাকে তিনি পাগল প্রতিপন্ন করেছিলেন।’’

বৃষ্টির জল

কেন্দ্রীয় সরকারের আমলাটি তাঁর নোটে বলেছেন, কলকাতার ভূগর্ভে জলস্তর যে ভাবে কমছে, পুকুর, ডোবা, নয়ানজুলি বুজিয়ে বাড়িঘর, বাজার তৈরি হচ্ছে তাতে মহানগরীর মাটির নীচের প্রাকৃতিক ভারসাম্য দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে ভূগর্ভের জলের সঙ্গে উঠে আসা আর্সেনিকের পরিমাণও। নতুন স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে মহানগরীতে। পাশাপাশি বর্ষাকালে বৃষ্টির জল সব চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। অথচ ওই জল ধরে রাখার ব্যবস্থা হলে শহরের বহুতল বাড়িগুলিকে অন্তত বর্ষার সময়টায় ভূগর্ভের জল তুলতে হত না।

কলকাতা পুরসভার কাছে এ ব্যাপারে কী দাবি ওই পরিবেশপ্রেমী কেন্দ্রীয় সরকারের ওই আমলাটির? ওই আমলা চান, বাড়ির নকশা অনুমোদনের সময়ে বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা ব্যবহার করা সংক্রান্ত যে ধারাটি কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং রুলের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেটিকে সক্রিয় করুক কলকাতা পুরসভা। আমলাটি আরও চান, রেনওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প না দেখালে কোনও বহুতলকে যেন নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দেওয়া না হয়। এনওসি না পেলে কোনও বাড়িতে মানুষ ঢুকে বসবাস করতে পারবে না। তাঁর উপলব্ধি, আঙুল না বেঁকালে কোনও ভাল কাজ করা যায় না। তিনি চান, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যেন নতুন পুরবোর্ড কলকাতাকে পরিবেশবন্ধু শহর হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়।

পরিশেষে আমলাটি লিখেছেন, গঙ্গার ঘাট বাঁধানো থেকে শুরু করে প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে গঙ্গা পরিষ্কার এবং জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজে বিবর্তন এনেছে কলকাতা পুরসভা নিজেই। শহরের রাস্তার মাঝে বুলেভার্ড করে সেখানে ছোট গাছ লাগিয়ে শহরের মুখ বদল করতেও সক্ষম তারা। তাই তাঁর এই সামান্য ক’টি সুপারিশ কার্যকর করাটা শহরের মানুষের স্বার্থে আগামী পুরসভার কাছে এমন কিছুই নয়। ওই সব সুপারিশের কোনওটিতেই পুরসভাকে একটি পয়সা পর্যন্ত খরচ করতে হবে না। শুধু শহরবাসীকে বাঁধতে হবে নিয়মে। কোনও রাজনৈতিক দলের স্বার্থ এতে বিঘ্নিত হবে না। অথচ আরও সুন্দর হবে শহরের পরিবেশ। বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে, পরিস্রুত জল পান করে বাস করতে পারবেন কলকাতাবাসী।

সুপারিশমালার একেবারে শেষে ফের এক বার কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পকে নিয়ে টিপ্পনী কেটেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের আমলাটি। তাঁর মন্তব্য, যে বিষয়গুলি স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের মধ্যেই আসা উচিত ছিল, সেগুলি আমার মতো একজন সাধারণ নাগরিককে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নগোরন্নয়ন দফতরেরই এই সব বিষয়গুলি দেখা উচিত ছিল। আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পে স্বচ্ছ চিন্তার বড় অভাব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE