বা জার আসিয়া বাংলা ভাষাকে লইয়া গিয়াছে। বিশ্বায়িত কর্মভূমিতে কাজের ভাষা প্রায় নির্বিকল্প ইংরাজি। দেশের বাজারে ইদানীং বিনোদন ও খুচরা আদানপ্রদানের ভাষা হইয়া উঠিয়াছে পঞ্জাবায়িত হিন্দি। ফলে, বাংলা ভাষা না ধর্মে লাগে, না জিরাফে তাহার ব্যবহার আছে। ফলে, অবাঙালিরা তো বটেই, বাঙালিরাও ক্রমে পাঠ্যক্রম হইতে বাংলাকে দূরে সরাইয়া দিতেছে। যে ভাষা ‘কাজে লাগে না’, তাহা শিখিয়া আর কী লাভ! অনেকে ধরিয়া লন, মাতৃভাষা যখন, তাহা শিখিতে আর বাড়তি চেষ্টার প্রয়োজন কী? বঙ্গসন্তানেরা এখন ‘আই লাভ গরম ভাত উইথ পাতলা মাছের ঝোল’ বলিতে পারাকেই বাংলাচর্চার পরাকাষ্ঠা ভাবিতেছেন। অতএব, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী যখন ঘোষণা করিলেন, পশ্চিমবঙ্গে দশম শ্রেণি অবধি সব ছাত্রছাত্রীকে বাংলা পড়িতেই হইবে, সেই ঘোষণাকে অকুণ্ঠ স্বাগত জানানোই বিধেয়।
তবে, মন্ত্রিমহোদয়ের সহিত দ্বিমত হইবারও অবকাশ আছে। তিনি দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্যের উদাহরণ পেশ করিয়া বলিয়াছেন, সেখানে যেহেতু চাকুরি পাইবার জন্য স্থানীয় ভাষার জ্ঞানকে কার্যত আবশ্যিক করিয়া ভিন্রাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য বাধা সৃষ্টি করা হইতেছে, পশ্চিমবঙ্গও সমতুল বাধা তৈরি করিবে— তাহাতে সমতাবিধান হইবে। অর্থাৎ, ভাষা দ্বাররক্ষী হইবে। এই নেতিবাচক ব্যবহারের বিপ্রতীপ প্রান্তে আছে অন্তর্ভুক্তির যুক্তি। বাংলার সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করিতে হইলে বাংলা ভাষা শিক্ষার কোনও বিকল্প নাই। বাঙালি হউন বা অবাঙালি, যাঁহারা পশ্চিমবঙ্গকেই তাঁহাদের ঠিকানা করিতে চাহেন, রাজ্যের সংস্কৃতির সহিত তাঁহাদের সম্যক পরিচিতি আবশ্যিক। নচেৎ, বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য। রাজ্যের ভৌগোলিক পরিসরটিকে যদি বাঙালি জাতির পরিসর করিয়া তুলিতে হয়, তবে তাহার দরজা জানালা খোলা রাখিতেই হইবে। বাংলা ভাষা সেই প্রবেশপথ। স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা আবশ্যিক করাকে এই অন্তর্ভুক্তির যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠা করা ভাল। সত্য, অধুনা বাংলা ভাষার ‘বাজার’ নাই। ভাষাটি না শিখিলেও জীবিকানির্বাহে সমস্যা হইবে না। কিন্তু, বাজারের চাহিদা-জোগানের সমীকরণই শেষ সত্য নহে। ‘অপর’-এর জন্য দরজা বন্ধ করিয়া নহে, তাহাদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যদি বাঙালির জাতীয় পরিচিতি নির্মাণ করিতে হয়, তবে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করিতে হইবে। সেই দায়িত্ব সরকারেরই।
স্কুলে যে তিনটি ভাষা পড়ানো হইবে, তাহার মধ্যে একটি আবশ্যিক ভাবেই বাংলা হইবে। ইংরাজি যেহেতু আন্তর্জাতিক সংযুক্তির ভাষা, অতএব তাহাও আবশ্যিক। তৃতীয় ভাষাটির ক্ষেত্রে বিস্তারের অবকাশ রহিয়াছে। বাংলা বা ইংরাজি যাঁহাদের মাতৃভাষা নহে, তৃতীয় ভাষা হিসাবে তাহারা মাতৃভাষা শিখিবে, তাহাই প্রত্যাশিত। পাশাপাশি, সংস্কৃত, লাতিন, ফার্সির ন্যায় ধ্রুপদী ভাষা শিখিবার ব্যবস্থা থাকাও বিধেয়। যে কারণে বাংলা শেখা জরুরি, ধ্রুপদী ভাষা শিক্ষাও ঠিক সেই কারণেই প্রয়োজন। প্রতিটি ভাষাই নিজস্ব সংস্কৃতিকে বহন করে। সেই সংস্কৃতির শিক্ষা বহুত্বের পাঠ দেয়। ভারতীয়ত্ব অথবা মনুষ্যত্ব, বা আন্তর্জাতিকতা, এই কথাগুলি বলিতে প্রকৃতার্থে ঠিক কী বুঝায়, সাংস্কৃতিক বহুত্বের পাঠ ভিন্ন তাহা উপলব্ধি করা অসম্ভব। মৌলবাদের প্রাবল্য হইতে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করিতে ভাষাই অস্ত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy