আগরতলায় মমতা
১৯৮৮ সালের কথা। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তখন নৃপেন চক্রবর্তী। রাজ্যে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল। নির্বাচনী দায়িত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবকে আগরতলায় পাঠালেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছলাম আগরতলায়। সেটা ছিল আমার প্রথম ত্রিপুরা সফর। জীবনে প্রথম বিমানে চড়াও বটে। নৃপেন চক্রবর্তীর মতো সৎ, একনিষ্ঠ, কমিউনিস্ট নেতা কমই দেখা যায়। তার উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দশরথ দেব। নৃপেনবাবু ছিলেন বাঙালি নেতা। আর দশরথবাবু উপজাতি নেতা ছিলেন। দশরথবাবুর একটা নিজস্ব উপজাতি সংগঠনও ছিল। তার নাম ছিল ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ’। নৃপেনবাবু এবং দশরথবাবু দু’জনে কেউই আজ নেই। সে সময়ে এই দুই নেতার মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। দশরথবাবু মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। যদিও দশরথবাবু ছিলেন ত্রিপুরার উপজাতি সমাজের ভূমিপুত্র।
পঞ্চাশের দশকে নৃপেনবাবুকে পাঠানো হয়েছিল ত্রিপুরায়। তাঁর উপস্থিতিতে একটি বাঙালি নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল দলের মধ্যে। উপজাতি পার্টি-কর্মীদের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতা বোধ তৈরি হয়েছিল। নৃপেনবাবুর দীর্ঘ শাসনে দলীয় কোন্দল বেড়েছিল, দুর্নীতি এসেছিল, নৃপেনবাবুর মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন একনায়কতন্ত্র এসেছিল, আর সেই সুযোগে উপজাতি বিচ্ছিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে বিজয় রাংখেলের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল টিএনভি। সন্তোষমোহনবাবু দায়িত্ব পেয়ে এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে উস্কে দেন। শুরু হয় টিএনভি-র সন্ত্রাস। একের পর এক হত্যাকাণ্ড। উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা। সেনাবাহিনী পাঠানো। এবং অবশেষে প্রবল হিংসার মধ্যে দিয়ে সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হয়। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুধীর মজুমদার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তিনিও আজ প্রয়াত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমীর বর্মণ। যার ছেলে সুদীপ বর্মণ আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের নেতা।
এখনও মনে পড়ে সেই নাটকীয় প্রস্থানের পর রাজভবনে যখন সুধীর মজুমদার শপথ নিতে গেলেন, তখন তাঁর মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই হাওয়াই চটি পরে রাজভবনে হেঁটে শপথ নিতে গিয়েছিলেন। সুরজিৎ-বিরোজিৎ সিংহ, মহিলাল-রতন— আরও অনেকে। এই নেতারা সে দিন শপথগ্রহণের পর অনেকেই হাওয়াই চটি পরেই সাদা অ্যাম্বাসাডরে চড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই সময় সন্তোষবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন মমতা। তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের যুব কংগ্রেসের নেত্রী। দামাল মমতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে। সন্তোষবাবু এবং তাঁর ভক্ত প্রয়াত মনোরঞ্জন ভক্ত ত্রিপুরায় প্রচারের জন্য মমতাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ত্রিপুরা রাজভবনের উল্টো দিকে পুরনো সার্কিট হাউসের দোতলার কোণার ঘরে থাকতেন মমতা। আর দু’-তিন দিনেই মমতা বানিয়েছিলেন নিজের মহিলাবাহিনী। সন্তোষবাবুর নেতৃত্বে সুধীর-সমীরের সরকার গঠনে সে দিনও মমতার ভূমিকা কম ছিল না।
প্রায় ত্রিশ বছর পর আজ তিনি আগরতলায় পৌঁছেছেন। নতুন এক পরিস্থিতি।এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী। পাঁচ বছর অতিক্রম করে সেখানে সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেছেন তিনি। আগরতলায় এখন নৃপেনবাবুর শিষ্য মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রী। ছোট রাজ্য। দু’টি লোকসভা কেন্দ্র। কিন্তু, উত্তর ত্রিপুরার ধর্মনগর-কাইলাশহর আর দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া পর্যন্ত ভূখণ্ডে একচ্ছত্র নেতা মানিক সরকার। ত্রিপুরায় মমতার প্রধান সেনাপতি মুকুল রায় এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, মানিক সরকারের প্রশাসনেও দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। সেই দুর্নীতিকেও তৃণমূল এ বার ফাঁস করবে। ত্রিশ বছর আগে সন্তোষবাবু যে কাজটি করেছিলেন, আজ মানিক-যুগে সেই কাজটি করতে চাইছেন মুকুলবাবু।
নৃপেনবাবু যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন কাছ থেকে দেখেছিলাম মানিকবাবুকে। নিপাট ভাল মানুষ। পাজামা-পাঞ্জাবি পড়তেন। নিজের পাঞ্জাবি নিজেই ইস্ত্রি করতে দেখেছি তাঁকে। যাতায়াত করতেন রিকশায়। এ হেন মানিকবাবু দারুণ ভাবে বদলে গিয়েছেন, এখনও এমনটা মনে করতে পারি না। তবে এ কথা সত্য, সিপিএমের দীর্ঘ শাসনেও জেলায়-জেলায় তৈরি হয়েছে তীব্র অসন্তোষ। সন্ত্রাস আবার বাড়ছে। সেই বিজয় রাংখেল এখন নখদন্তহীন প্রাক্তন বিধায়ক। কিন্তু বাঙালি-উপজাতি বিচ্ছিন্নতা ক্রমবর্ধমান। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস শক্তিহীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা সেখানেও আছড়ে পড়েছে। সেই পরিবর্তনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতেই মমতা এ বার ত্রিপুরায়।
মমতা কি সফল হবেন?
ভবিষ্যৎ বলবে ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে ভাবে নৃপেনবাবু ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন তাতে কিন্তু কংগ্রেস দীর্ঘ দিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতির মতো সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়েও কংগ্রেস শেষ রক্ষা করতে পারেনি। এ বার যদি চটজলদি কোনও ‘অপারেশন’-এ না গিয়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে যদি মমতা এগোন, তবে তাতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু তাতে সাফল্য হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী। ত্রিপুরা তাই মমতার কাছে এক নতুন অধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy