সাংসারিক ও পারমার্থিক, দুই পথ বিপরীত। তবু এক একটি বিরল মুহূর্তে দুই যেন মিলিয়া যায়। কুমোরটুলি হইতে তেমনই এক সংবাদে যেন পঞ্চমে সুর বাজিয়া উঠিল। প্রায় দুইশত দুর্গাপ্রতিমা বিক্রয় না হইয়া রহিয়া গিয়াছে। সেগুলিতে কিঞ্চিৎ বদল করিয়া জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি করিতে পারেন, জানাইয়াছেন মৃৎশিল্পীরা। ইহা এক প্রকার গৃহিণীপনা। সংসারের কিছুই ফেলিবার নহে। কোনও জিনিস নষ্ট না করিয়া কাজে লাগাইবার কৌশলই সংসারের শিল্প। আচার, মোরব্বার উৎস সেই তাগিদ হইতেই। মরসুমি আম, কুল, বেল পচিয়া নষ্ট হইবার সম্ভাবনা এড়াইতে তেল-মশলা সহযোগে তাহা সংরক্ষিত হয়, দীর্ঘ দিন ধরিয়া আহারের পাতে স্বাদবৃদ্ধি করে। সব্জির ফুল, ফল, বীজ, খোসা, কিছুই না ফেলিয়া সেগুলিকে আহারের উপাদেয় উপকরণ করিবার দক্ষতা গৃহিণীরা অর্জন করিয়াছিলেন। নারিকেল কুরাইয়া তাঁহারা সুস্বাদু মিষ্টান্ন যেমন বানাইয়া থাকেন, তেমনই ছোবড়া জ্বালিয়া ধুনা দেন, পাতা হইতে কাঠি বাহির করিয়া সম্মার্জনী প্রস্তুত করেন। পুরাতন শাড়ি হইয়া উঠে নূতন কাঁথা। যাহা ছিল পর্দা, তাহাই ফুল-পাতার নকশায় সাজিয়া, ঝালর লাগাইয়া বসিবার আসন হইয়া উঠে। এই সাংসারিক নিয়ম মানিয়াই দশপ্রহরণধারিণী দুর্গার মূর্তি হইবে শঙ্খ-চক্র, ধনুর্বাণধারিণী জগদ্ধাত্রী, তাহাতে আশ্চর্য কী?
আশ্চর্য এই, মহামায়ার যে ভাবমূর্তি চিন্তা করিয়াছিলেন প্রাচীন শাস্ত্রপ্রণেতারা, তাহার মধ্যস্থলে ছিল এমন রূপান্তরের কল্পনা। মধুকৈটভ, মহিষাসুর এবং শুম্ভনিশুম্ভ, সকল অসুরকে নাশ করিয়াছেন একই দেবী, ভিন্ন ভিন্ন রূপে। তিনি অসুরবাহিনী সংহারের জন্য নিজের মধ্য হইতে ব্রহ্মাণী, ইন্দ্রাণী, নারায়ণী প্রমুখ বিবিধ দেবী সৃষ্টি করিয়াছেন, আবার তাঁহাদের নিজের অভ্যন্তরে সংবরণ করিয়া বলিয়াছেন, ‘‘দ্বিতীয়া কা মমাপরা’’— আমিই একমাত্র, দ্বিতীয় কেহ নাই। শাস্ত্রোক্ত এই বোধটি সামূহিক মানসজগতে ছাপ ফেলিয়াছে। ইহা কেবল পরাসত্যের কারবার নহে। যিনি দুর্গ অসুর বিনাশকালে সিংহবাহিনী দুর্গা, তিনিই অনাবৃষ্টিতে শাকম্ভরী, এই দৈবরূপ কল্পনার মধ্যে কি সাংসারিক প্রয়োজনেরও ছাপ নাই? এই সংযোগের জন্যই মহামায়া বিশ্বরূপা হইয়াও বাঙালির ঘরের কন্যা। শক্তিরূপিণীর নিকট বরপ্রার্থনা করিয়াও উমার জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া দিন কাটাইতে হয়।
মানবসংসারের সঙ্কট অনুসারে দুর্গতিনাশিনী দেবীর রূপচিন্তা, এই সূত্রটি ঐহিক ও দৈবজগৎকে যুক্ত করিয়াছে। তাই যুগে যুগে সমাজ-সংসারের নূতন সঙ্কটসাগর মন্থনে উঠিয়াছে নানা মূর্তি, আর তাহাকে আরাধনার নানা রীতি। এ বার কলিকাতার একটি ক্লাব দুর্গাপূজা শেষে মণ্ডপ প্রাঙ্গণেই মৃন্ময় মূর্তিটি জলে দ্রব করিল। পরিবেশ বিধি ও স্বাস্থ্য বিধি মানিয়া বিসর্জন হইল। নদীতে নিরঞ্জনের প্রচলিত রীতির ইহা ব্যতিক্রম, কিন্তু আজিকার পরিবেশ-সঙ্কটের নিরসনে ইহাই যথাযথ। বিবিধ রাসায়নিকে জলদূষণ ও জলজ প্রাণীর বিপন্নতা বৃদ্ধি না করিয়া, মৃন্ময়ী মূর্তির রূপান্তর মানিতে সমস্যা কোথায়? চতুর্ভুজা রূপে দেবীর পুনঃপ্রকাশ অথবা উপাদানে গলিত হইয়া তাঁহার অন্তর্ধান, সবই কি ভক্তের চক্ষে জগদ্ধাত্রী রূপ নহে? যিনি সকল প্রাণীর অভয়দাত্রী, তাঁহার পূজাতেও সকল জীবের শুভ কিসে, অশুভ কিসে, তাহা মনে রাখিতে হইবে বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy