Advertisement
০২ মে ২০২৪
মিডিয়া, শিল্প মহল, হলিউড, বিরোধী সমাজ সকলে মিলে লড়লেন
US Presidential Election 2020

তবুও তো চাকা ঘুরল 

কথাটা এই যে, ট্রাম্প যতই প্রতাপশালী হন না কেন, আমেরিকার পুঁজিপতিদের সবাই কিন্তু তাঁর পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েননি।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২০ ০১:৫৭
Share: Save:

আমেরিকার এ বারের ভোটের খবরে নজর রাখতে রাখতে কেবলই গত বছরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমেরিকার ২০২০ যেন ভারতের ২০১৯। একই মোড়ে দাঁড়িয়ে দুটো দেশ ভোট দিল। দু’রকম রাস্তা বেছে নিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের পিছনে কোভিড যদি একটা বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে, এ দেশে ২০১৯-এর আগে অনেকেই মনে করেছিলেন নোটবন্দি এবং অসহিষ্ণুতার রমরমা সেই ভূমিকা পালন করবে। করেনি। ফলত মোদীজির ‘দোনো হাত মে লাড্ডু’। ট্রাম্পের ভাগ্য অতটা সদয় হল না।

জনমনে বিদ্বেষকে খুঁচিয়ে তুলে তাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা, একের পর এক জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ চড়া জাতীয়তাবাদের মোড়কে পুরে বাজারে চালিয়ে দেওয়া, নানা রকম সন্দেহজনক কাজকর্মকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা— ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে মোদীর ভারতের মিল বড় কম নয়। বিনা কারণে ওঁদের মধ্যে গলাগলির ঘনঘটা দেখা যায়নি। এমনি এমনিই মোদী ট্রাম্পের হয়ে প্রচারে আমেরিকায় ছুটে যাননি। ট্রাম্পও অকারণে ‘কেমছো’ শুনতে এত দূর উজিয়ে আসেননি।

ইত্যাকার আয়োজনের পরেও ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার হোয়াইট হাউসে ফেরা হল না কেন, তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলবে। এবং সেই বিচার-বিশ্লেষণের দু’টি অভিমুখও থাকবে— এক, চার বছরের ‘কুশাসন’ দেখার পরেও, এই অতিমারির বিপর্যয় মাথার উপরে নিয়েও ট্রাম্প এত ভোট পান কী করে। দুই, যাবতীয় লম্ফঝম্প এবং গলাবাজিকে শেষ পর্যন্ত পরাস্ত করে জো বাইডেন জিতলেন কী করে। এই দু’টি অভিমুখ পরস্পরবিরোধী নয়, খুব বেশি করেই একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বরং বলা উচিত, ভাবনার এই দুই খাতকে যত বেশি সম্ভব সম্পৃক্ত করে রাখাটাই এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম কর্তব্য। প্রথম অভিমুখটির মধ্যে আছে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার অতি প্রয়োজনীয় সতর্কীকরণ। দ্বিতীয় অভিমুখটিতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অক্সিজেন।

২০০৮-এ বারাক ওবামা যে-দিন জিতলেন, তাঁর বিখ্যাত বিজয়-ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকায় পরিবর্তন এসেছে। তাঁর সেই কথাটা সে-দিন ফাঁকা আওয়াজ বলে মনে হয়নি কারও। আমেরিকা যে সত্যিই এক জন কৃষ্ণাঙ্গকে প্রেসিডেন্ট পদে বরণ করে নিল, সেটা একটা বৃহৎ পরিবর্তনের প্রতিফলন বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। আট বছরের মাথায় সেই ওবামাকে বিদায়ী ভাষণে বলতে হল, ‘‘আশা করি আমেরিকা তার মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলবে না।’’

ওবামার পরে ট্রাম্প— এই বদলটা কিন্তু স্রেফ ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানের নয়। টানা আট বছর ডেমোক্র্যাট শাসনে থাকার পর আমেরিকা একটু স্বাদ বদলাতে চেয়েছিল, বললে এর ব্যাখ্যা মেলে না। বরং ওবামার পরেই যে ট্রাম্প, ট্রাম্পই— এই ঘটনাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমেরিকার গোঁড়া শিবিরটি আসলে মনে মনে কতখানি ফুঁসছিল আট বছর ধরে। জন ম্যাকেন বা মিট রমনির দ্বারা যা হয়নি, ট্রাম্প সেটাই করলেন— খোলাখুলি বিদ্বেষের তাসটা খেলে দিলেন। ম্যাকেন বা রমনির সঙ্গে ট্রাম্পের তফাতটা এখানে অনেকটা যেন অটলবিহারী বাজপেয়ী আর নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের মতো।

উল্টো দিকে ডেমোক্র্যাটরা কী করলেন? পর পর দু’বার জয় পেয়ে এবং হিলারি ক্লিন্টনকে দাঁড় করিয়েই ওঁরা বেশ নিশ্চিন্ত ছিলেন। ভেবেছিলেন, প্রশাসনে অনভিজ্ঞ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয় সহজেই আসবে। ‘পরিবর্তিত’ আমেরিকা ট্রাম্পের তালে নাচবে না। অনেকে তাই সে বার ভোট দিতেও যাননি। বদলে চার বছর ধরে খেসারত দিয়েছেন। এ বারে তাই রেকর্ড সংখ্যক ভোট পড়েছে। গুনতির পর্ব চুকতেই অনেকখানি সময় লেগে যাচ্ছে। কিন্তু সঙ্কেতটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট— এ বারের ভোটের গুরুত্ব বুঝতে ওঁরা আর ভুল করেননি।

অথচ ক’মাস আগেও রীতিমতো ছত্রভঙ্গ ছিল ডেমোক্র্যাট শিবির। প্রার্থী বাছাই করাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৭৮ বছরের বৃদ্ধ জো বাইডেনকে নিয়ে হাসাহাসিও কম হয়নি। কিন্তু এখানেও ভারতের সঙ্গে তফাতটা চোখে না পড়ে পারে না। ‘‘আমি তো বার্নি স্যান্ডার্সের ভক্ত, অতএব বাইডেনকে ভোট দেব না, ট্রাম্পকে দেব’’— এই মনোভাব আমেরিকানদের মধ্যে দৃশ্যত নেই বললেই চলে। প্রার্থী বাছাই নিয়ে যাবতীয় লড়াই প্রাথমিক স্তরেই শেষ হয়ে যায়। তার পর যিনিই প্রার্থী হন, দলীয় সমর্থকদের ভোট তাঁর বাক্সেই যায়। নির্দিষ্ট শিবিরভুক্ত নন, এমন ভোটারেরাও অনেকেই মন ঠিক করতে দ্বিধা করেননি। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াটা যেখানে বড় কথা, সেখানে বাইডেন বুড়ো না জোয়ান, বুকনিতে ভারী না ক্যারিশমায় কম— এ সব নিয়ে মাথা ঘামাননি। আবার যবে দেবতুল্য নায়ক আসবেন, তবে আবার ট্রাম্পের বিরোধিতা করার কথা ভাবব— এই মনোভঙ্গি ওঁদের চালিত করেনি। ভারতে বহুদলীয় বিরোধী শিবির কিন্তু এখনও এ ভাবে এককাট্টা হতে পারেনি। এ দেশের বহুধাবিভক্ত কাঠামোয় সেটা হওয়াও খুব কঠিন। ১৯৭৭-এর ইতিহাস একই সঙ্গে সেই সাফল্য এবং ব্যর্থতার দলিল।

আরও একটা বড় তফাত নজর করার মতো। ‘আমার সব ভোট ওরা চুরি করে নিল’ বলে হুঙ্কার দেওয়ার সময় ট্রাম্প আরও একটা কথা বলেছেন। ‘‘সব বড়লোক আর সব মিডিয়া ওদের পকেটে পোরা!’’ ধনকুবের ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখে এ কথা শুনলে প্রথমে হাসি পেতে পারে। এ প্রশ্নও জাগতে পারে যে, প্রচারের কাজে টাকা কম পড়েছিল নাকি? আগে বলেননি তো! কিন্তু কথাটার আসল গুরুত্ব অন্যত্র। ট্রাম্প না বললেও সেটা গুরুত্বপূর্ণই থাকত। ট্রাম্প বাক্যটা উচ্চারণ করে তাকে একেবারে সামনে নিয়ে এলেন।

কথাটা এই যে, ট্রাম্প যতই প্রতাপশালী হন না কেন, আমেরিকার পুঁজিপতিদের সবাই কিন্তু তাঁর পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েননি। সংবাদমাধ্যমের বৃহদংশও তার মাথা বিকিয়ে দেয়নি। বাজারে প্রতিযোগিতা আর ভারসাম্যের যে নীতির কথা ওঁরা ঘরের মাটিতে অন্তত মেনে চলার কথা বলেন, সেটা একেবারে উল্টিয়ে যায়নি। এমনকি আগেভাগেই জয় ঘোষণা করা আর ভোট চুরির রব তোলার ব্যাপারটা রিপাবলিকানদের মধ্যেও একটা বড় অংশ ভাল চোখে দেখেননি। তাঁরা সে কথা জানাতেও কার্পণ্য করেননি এবং সেই খবর ট্রাম্পের প্রিয় ফক্স টিভিও দীর্ঘ ক্ষণ ধরে সম্প্রচার করেছে। ভারতের মিডিয়া-গোসাঁইরা এটা করতেন কি? ট্রাম্প জেতার পরে প্রথম অস্কার-রজনীর কথাও মনে পড়ে বেশ। গোটা হলিউড কার্যত সে বার শপথ নিচ্ছিল, ‘আমরা বহুত্ববাদের নীতি থেকে সরব না’। রবার্ট ডি নিরো, মেরিল স্ট্রিপ, লিয়োনার্ডো ডি ক্যাপ্রিয়োরা দল বেঁধে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে সেলফি তুলতে যাচ্ছেন— এমন দৃশ্য তাই আমরা দেখিনি।

এমন অনেকগুলো না-দেখা তিলে তিলে যোগ করেই বাইডেন জিতে গেলেন। ট্রাম্প খুশি হতে পারেন এই ভেবে, তাঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দীর্ঘমেয়াদি দুশ্চিন্তার বীজ বপন করে দিয়ে গেল। ট্রাম্পের পক্ষে বিপুল ভোট এবং শেষ পর্যন্ত বাইডেনের প্রায় টাইব্রেকার-সুলভ ম্যাচ জেতা উদ্বেগই বাড়াল বেশি।

ইতিমধ্যে আমাদের পাশের রাজ্য ভোট দিচ্ছে। পরের বছর আমরা দেব। ২০২৪-এ আমেরিকা আর ভারত ফের ভোটে যাবে। গুরুজনেরা বলে গিয়েছেন, ভাবিয়া করিয়ো কাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE