Advertisement
E-Paper

কেতাদুরস্ত দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে মরিয়া গ্রাম?

বদল বা পরিবর্তন মানেই যে খারাপ তা নয়। তবে, যে বদলের কথা লিখতে চাইছি, তার সুফল পেতে গেলে আত্মীকরণের সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে।

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৪

কাজের সূত্রে যাঁদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেতে হয়, তাঁরা জানেন, গ্রামীণ মানুষের মানসিক জগৎ কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গোটা রাজ্যের বাকি প্রান্তের মতোই উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলেও পরিবর্তনের স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে। এই বদল, এই মানসিক পরিবর্তন অবশ্য পাকা সড়কের উপর দিয়ে বাসের জানালা থেকে চেয়ে চেয়ে গ্রাম দেখলে সহজে চোখে ধরা পড়ে না। এই বদলের আন্দাজ পেতে গেলে গ্রামীন মানুষের মনে উঁকি দিতে হবে।

বদল বা পরিবর্তন মানেই যে খারাপ তা নয়। তবে, যে বদলের কথা লিখতে চাইছি, তার সুফল পেতে গেলে আত্মীকরণের সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সেলফোন বা মোবাইল এখন জনপ্রিয়। কথা বলার জন্য সাধারণ মোবাইল ফোন নয়। তা আজ গ্রামসমাজে প্রায় অকেজোই। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখন অন্তত একটা স্মার্টফোন পাওয়া যাবেই। সেই স্মার্টফোনের দৌলতে গ্রাম আজ অনেকটাই ‘আপডেটেড’। দুনিয়াদারির হালহকিকত সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এখন গ্রামসমাজ। গ্রামীণ বাঙালি আজ আর সে ভাবে পৃথিবীর এক কোণে পড়ে নেই ‘ভার্চুয়াল’-অর্থে গ্রামের মানুষের অনেকেই আজ কেতাদুরস্থ দুনিয়াদারির খোঁজ রাখতে জানেন। তবে, ভাবনা একটিই— কেতাদুরস্ত দুনিয়ার আদপকায়দা শিখে নিতে গিয়ে তাঁরা ময়ূরপুচ্ছ ধারণের কৃৎকৌশলটাই শুধু শিখে ফেলছেন না তো!

ধরে নেওয়া যেতে পারে, এটাই গ্রামবাংলার হালফিলের শিক্ষাচিত্র। পশ্চিমবাংলার প্রত্যন্ত জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের একটি গ্রামের কথাই ধরা যাক। গ্রামটি এমন গ্রাম, যেখানে এক বছর আগেও পাকা সড়ক ছিল না। জাতীয় সড়ক থেকে একটা মাটির রাস্তা নেমে গিয়েছে গ্রামের ভিতর। বর্ষায় সে রাস্তায় প্যাচপ্যাচে কাদা আর গরমে ধুলো উড়তে দেখা যেত। এই গ্রামের মাঝখানে সরকারি প্রাথমিক স্কুল।

এখন সেখানে একটা নতুন দৃশ্য চোখে পড়ে। দেখা যায়, সদ্য তৈরি হওয়া পাকা রাস্তা ধরে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের হলুদ বাস ঢুকে যাচ্ছে গ্রামে। একটা বড় গাছের ছায়ায় কিছু গ্রামীণ মহিলা গোল হয়ে বসে রয়েছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে যেতে চাইছে তখন। কয়েকজন পুরুষ একটু দুরে সাইকেল নিয়ে অপেক্ষারত। স্কুলবাসটি সেখানে এসে থামে। বাস থেকে নামে জুতো-মোজা-টাই পরা গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে। বাবা-মায়েরা হাত ধরে বা কাউকে কোলে নিয়ে রোদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে যে যার ঘরে যাচ্ছেন স্কুলফেরত বাচ্চা নিয়ে। এই বাচ্চাদেরই একটু বাদে দেখা যায় মলিন, ছেঁড়া জামা-প্যান্ট পরে রাস্তায় রাস্তায় হুটোপুটি করতে।

এই সব বাচ্চাদের মা-বাবার একফালি জমি থাকে। দিল্লি কি মুম্বইয়ে কাজ করেন সেই সব মা-বাবার কেউ কেউ। তাঁরা ফিরে এসে অথবা মাসে-মাসে টাকা পাঠিয়ে কিছু জমিজিরেতও বাড়ান বা করেন। এঁদের অনেকেই নিজেরা মাঠে কাজ করেন সারা বছর। ফসল বোনা বা কাটার সময় বড়জোর দু’একদিনের জন্য জনমজুর নিতে পারেন তাঁরা। জমিতে সেচ দেওয়া, আগাছা নিরানো, সার দেওয়া, কীটনাশক স্প্রে করার কাজ নিজেরাই করেন। এঁরা কেউ কেউ সই করতে পারলেও দু’লাইন বাংলা লেখাও পড়ে শেষ করতে পারেন না। তার আগেই তাঁদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী? বিষয়টা হল, ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে পাঠানো গ্রামের ওই বাচ্চাগুলো আদতে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। ‘ফার্স্ট-জেনারেশন লার্নার’। অর্থাৎ, প্রথম প্রজন্মের গ্রামীণ বাঙালি পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমে।

গ্রামের এই সব শিশু, যারা রোজ বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রঙিন বাস থেকে নামে, তাদের সিংহভাগই বিপিএল রেশনকার্ড-ধারী পরিবারের। সামান্য কিছু নিজস্ব জমি থাকলেও সময়-সুযোগ পেলে সেই পরিবারের লোকজন একশো দিনের কাজ করেন। এই পরিবারের শিশুগুলোর নাম বাংলা মাধ্যমের সরকারি প্রাইমারি স্কুলেও রাখা থাকে। কারণ, পরিবার জানে, সরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণি উত্তীর্ণ শংসাপত্রটি প্রয়োজন ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা বিভাগের কোনও সরকারি চাকরি পেতে গেলেও। এই বাচ্চাদের বাবা–মা সরকারি স্কুল থেকেই প্রিম্যাট্রিক স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেন। এঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সে টাকা ঢোকেও।

কিন্তু বাচ্চাগুলোর অবস্থা ঠিক কেমন? যেদিন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ থাকে বা যেদিন নিজে থেকেই যায় না সেখানে, সেদিন তারা গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসে। সেই সমস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাত্রেই জানেন, ওই সব বাচ্চাদের বেশির ভাগই সরকারি প্রাথমিক স্কুলের নিয়মিত বাচ্চাদের চেয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে। তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া না পারে ঠিক ভাবে বাংলা রিডিং পড়তে, না পারে ইংরেজি রিডিং। অঙ্কের অবস্থাও তথৈবচ। এখন সরকারি স্কুলে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকও যথেষ্ট কঠিন। ইংরেজি মাধ্যমের শিশু সমস্যায় পড়ে সে বই হাতে নিয়ে। (শেষাংশ আগামিকাল)

(লেখক দক্ষিণ দিনাজপুরের মহাদেববাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

North Bengal Mobile Village
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy