ছেলেটির বয়স কত হবে? আট-নয়? কোলে তোলার মতো ছোট মোটেই নয়। কোলে তুলে এক হাঁটু জলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা তো আরওই কঠিন। অথচ দেখো কাণ্ড, যে কোলে উঠেছে, কিংবা যিনি কোলে তুলেছেন, দুই জনেরই মুখে কেমন মিষ্টি হাসি! যেন দারুণ একটা ব্যাপার। যে এই মজাটা পেল না, বুঝল না কী হারাল!
সাধারণত বন্যাবিধ্বস্ত লোকালয়ের যে সব ছবি আমরা দেখি, এই রকম দেখি কি তাতে? দেখি না। দেখার কথাও না। ঘরবা়ড়ি সব ভাসিয়ে দিচ্ছে বন্যার হু-হু জল, সহায়সম্বল ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছে চকিত সংকটে, শীতল দেশকে শীতার্ততর করে দিয়ে জীবনযাপন নিমেষে সাক্ষাৎ বিপন্নতা। সেখানে মজা আসবে কোথা থেকে, কোন পথে, কেনই বা। ছবিটা তাই অন্য রকম। অ-সাধারণ।
ঠিক এই অ-সাধারণটাই দেখেছিলাম, মার্চের বরফঝ়়ড়ে পর্যুদস্ত শ্রীনগরে। গোটা শহর অচল হয়ে পড়ছে বরফে, বিদ্যুৎ নেই পরিবহণ নেই, তার মধ্যেই আটকে-পড়া যাত্রীদের ভরসা দিচ্ছেন স্থানীয় যুবকরা, ‘ভয় পাবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা তো এখানে এ ভাবেই থাকি, কেবল ঠান্ডা লাগাবেন না, আপনাদের অভ্যেস নেই তো!’ এয়ারপোর্টের কাচের দরজাটা ভাঙা, হিমশীতল হাওয়ার ঝাপটা ঢুকছে সেখান দিয়ে। এক তরুণ গিয়ে় প্লাস্টিকের একটা চাদর টাঙিেয় দিলেন, আর এক ধমক দিলেন অধৈর্য উত্তর ভারতীয় প্রৌঢ় যাত্রীকে। ‘বলছি না, ভেতরে বসে থাকুন, পারবেন এই ঠান্ডায় এতক্ষণ বাইরে দাঁড়াতে?’ জনা-সত্তর যাত্রীকে আতান্তরে ফেলে বন্ধ হয়ে গেল এয়ারপোর্ট, ওটাই দস্তুর, এমনিতেই সন্ধেয় সব বন্ধ হয়ে যায়, তার উপর আবার দুর্যোগ। কর্মীরা হাঁটা লাগালেন শহরের দিকে, অনেকখানি পথ, গাড়িঘোড়াও নেই কোনও, এক হাঁটু বরফ। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘ওই মিলিটারি দেখছেন, ওরা আগুন জ্বালবে, ওখানে গিয়ে দাঁড়ান, কষ্ট কম হবে।’ কোনও দরকার ছিল না, তবুও ওরা বলে গেলেন।
এত দিন শুনেছিলাম, কাশ্মীর অ-সাধারণ, প্রাকৃতিক অনুপমতার জন্য। না গেলে বুঝতাম না যে কাশ্মীর অ-সাধারণ কাশ্মীরিদের জন্যই। গ়ড়পড়তা ভারতীয়ের মাপে তাদের মাপা যায় না। ওদের আনন্দ, ওদের বিষাদ, ওদের বাঁচার ধরন, সবটাই ভিন্ ধাতুর। স্বতঃস্ফূর্ত। এই ছবিটাতেও সেটা আছে। নিজের চোখে দেখা ছবিগুলোতেও সেটা ছিল। তবু এটা মোটেই একটা দুটো মুহূর্তের কথা নয়। এটা একটা অন্য রকম জীবনযাপনের গল্প।
এই অন্য রকম গল্পটা কিন্তু ঘিরে আছে এক রাক্ষুসে মাপের অসহায়তা, বিপন্নতা, অরাজকতা। যে সব জিনিস আমরা ভাবতেও পারি না, তার মধ্যে রোজ বাঁচতে হয় ওদের, চব্বিশ ঘণ্টা, বারো মাস, বছরের পর বছর। শ্রীনগরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে প়ড়ে এই ভয়ানক রাক্ষুসেপনা। দিকে দিকে অসংখ্য বন্দুকধারী সেনার সন্দেহতীক্ষ্ণ চাউনি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই স্তম্ভিত হাতে কড় গুনলাম, পাঁচ মিনিটের রাস্তায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন সৈন্য, প্রত্যেকের বন্দুক— কাঁধে ঝোলানো নয়, হাতে ধরা। প্রতি গলির মোড়ে একগোছা সেনার টহল। প্রতি রাস্তায় সেনাদের পায়চারি। কে যাচ্ছে আসছে, কথা বলছে, গাড়ি থামাচ্ছে, সব দিকে তাদের ভ্রূকুটি-দৃষ্টি। কেন সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকে, সে তো পুরনো জানা কথা, কিন্তু কাশ্মীর দেখার আগে ঠিক কল্পনা করতে পারিনি এই সেনা-অধ্যুষিত ‘ভূস্বর্গে’ মানুষের প্রাত্যহিক বাঁচাটা কেমন হতে পারে। এ তো তাদের নিজের জায়গা, নিজের শহর। সেখানে রাষ্ট্রের এমনি নির্নিমেষ খবরদারির কোলে দিন কাটাতে কেমন লাগে ওদের?
রাষ্ট্রের এহেন প্রতাপ, এ দিকে কিন্তু প্রশাসন বলে কিছু নেই। আঁতিপাঁতি খুঁজেও অফিসকাছারি চোখে প়ড়ে না, বিদ্যুতের বিষম আকাল, সরকারি বেসরকারি সব রকম যানবাহনের অভাব। ভাঙাচোরা বা়ড়ি চারদিকে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল কলেজের বিল্ডিং সবই যেন ভৌতিক, প্রখর শীতেও তাদের ভাঙা জানলার কাচ দিয়ে শনশনে হাওয়া। যে শহর বছরের এতটা সময় বরফের মধ্যেই বাঁচে, দুর্যোগ মোকাবিলার ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই সেখানে। যেটুকু আছে, সবই সেনাবাহিনীর অনুগ্রহ। রাজ্য সরকারের কাজটা তবে ঠিক কী? এত ঘটা করে নির্বাচনের দরকারই বা কী? ভারতের পক্ষে যদি ওদের টেনে আনতেই হয়, সেনা দিয়েই সে কাজ হয়ে যাবে?
সেনাদের কেন কাশ্মীরিরা পছন্দ করে না, বলার দরকার নেই। তাদের সার্ভিস যতটা, অত্যাচার ততোধিক। কাশ্মীরিরা জেনে নিয়েছে, তাদের জন্য অন্য কেউ নেই, আছে শুধু তারা নিজেরাই। ঠিক এই ছবিটার মতো। পরিস্থিতি কোনও দিন ভাল হবে না, এর মধ্যেই বাঁচতে হবে যখন, হাসিমুখে সকলকে নিয়ে বাঁচা যাক। এ তাদের নিজেদের লড়াই। গত সেপ্টেম্বরের কথাই ধরা যাক না কেন। শতাব্দীর কালান্তকতম বন্যায় যখন গোটা উপত্যকায় হাহাকার, রাজ্য সরকার তিন দিনের আগে ন়ড়েচ়়ড়ে বসেনি। ঝিলম-চেনাব কূল ছাপিয়ে ততক্ষণে ডুবিয়ে দিচ্ছে জনপদ। হাতে হাতে কোলে কোলে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েছে মানুষ। আধমরাদের বাঁচানো, মরামানুষ খুঁজে বার করা, সেনাবাহিনী আসার আগেই অনেক দূর কাজ সারা।
সেনাবাহিনীকে ছোট করার দরকার নেই। বহু মানুষ বাঁচিয়েছে সেনা। অসম্ভব উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কাজকে এমন অমানুষিক বড় করে দেখানোরও দরকার নেই। দুই মাস ধরে দেশময় টেলিভিশনে কাশ্মীরের বন্যা এমন করে দেখানো হয়েছে, যেন ভারতীয় সেনাবাহিনীই একমাত্র ভরসা। এক বারও বলা হয়নি, কী হত ওই মানুষগুলো নিজেরা জান দিয়ে অবস্থা সামাল দিতে না নেমে পড়লে। সারা বছর ধরে বেঁচে থাকার যে যুদ্ধটা ওরা হাসিমুখে করে যায়, সেটা আমরা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না বলেই। আমরা কেবল অবাক হই, কেন ওরা সেনাবাহিনীকে ভালবাসে না, ভারত বস্তুটাকে বিশ্বাস করে না। কেন নিজেদের ওরা কাশ্মীরি বলে, আর আমাদের বলে ‘ইন্ডিয়ান’।
আমাদের বলে ইন্ডিয়ান, তবু সেই ইন্ডিয়ানরা কাশ্মীর নিয়ে কী ভাবল, কতটা ভাল-লাগা নিয়ে ফিরে গেল, তা নিয়ে ওদের কী গভীর চিন্তা। কত বার যে জানতে চায়, ভাল লাগল তো? আবার আসব তো? পরিবারের অন্যদের নিয়েও আসব তো? কত বার যে বলে ‘না জেনে কোনও অপরাধ করে ফেলিনি তো? করে থাকলে মাফ করে দিয়ো কিন্তু!’
স্বতঃস্ফূর্ততা জিনিসটা আমাদের শেখা হয়নি। তাই এই সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারি না। ওই অ-সাধারণ মেজাজটার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি না। মরতে মরতেও অমন করে হাসাটা ঠিক বুঝতে পারি না। কাশ্মীর থেকে যায় ইন্ডিয়ার বাইরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy