Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

উৎসবের আবহে পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত

পরিশেষে বলা যায় উৎসবের আনন্দ পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। পরিবেশ চেতনা আমাদের প্রধান বিষয় হয়ে উঠুক। গঙ্গা সহ অন্যান্য নদী এমনকি গ্রামীণ জলাশয়গুলিকে দূষণমুক্ত করে তুলতে হবে আমাদেরই। লিখছেন সুকমল দালাল।কেন্দ্রীয় সংস্থা এন.এম.সি.জি সম্প্রতি জানিয়েছিলেন গঙ্গা বা তার কোনও শাখা প্রশাখাতে প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া যাবে না। ভাসানের জন্য সংশ্লিষ্ট পুরসভা এবং গঙ্গা ও তার প্রশাখার নিকট সাময়িক জলাধার তৈরি করতে হবে।

বোলপুরের একটি জলাশয়ে ভাসছে প্রতিমার কাঠামো। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

বোলপুরের একটি জলাশয়ে ভাসছে প্রতিমার কাঠামো। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৩৭
Share: Save:

সদ্য শেষ হয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। হয়ে গিয়েছে কালীপুজোও। বাংলায় আরও অনেক পুজো এই সময় অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী নানান পুজো। উৎসব মানেই সীমাহীন আনন্দ। এই আনন্দের ব্যাপ্তি শহর থেকে গ্রামে। উৎসব শেষে বিষাদের সুর সর্বত্র। যেমন পুজোর শেষে বিসর্জন একটা বিষাদের সুর বয়ে আনে। আর বিসর্জন মানে ভয়ানক জলদূষণ। বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারী পুজো, শহর কলকাতা থেকে রাঢ়ের বিভিন্ন গ্রামে দূষণের বেনোজল প্রবেশ করেছে। ভারতবর্ষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক গঙ্গা নদী ও তার বিভিন্ন শাখা প্রশাখা কেউ মুক্ত নয় দূষণের এই প্রকোপ থেকে।

কেন্দ্রীয় সংস্থা এন.এম.সি.জি সম্প্রতি জানিয়েছিলেন গঙ্গা বা তার কোনও শাখা প্রশাখাতে প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া যাবে না। ভাসানের জন্য সংশ্লিষ্ট পুরসভা এবং গঙ্গা ও তার প্রশাখার নিকট সাময়িক জলাধার তৈরি করতে হবে। নিয়ম ভাঙলে সংশ্লিষ্ট পুরসভাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।

যদিও রাজ্যে ২০১০ সালের দূষণ পর্ষদের গাইড লাইন অনুযায়ী ভাসানের পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। সেসময় নির্দেশ এসেছিল বিসর্জনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিমার কাঠামো সহ অন্যান্য আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে হবে। যেগুলি পুনর্ব্যবহার করা যায় করতে হবে। বাকি বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা যাবে না। এ বছরেও শহর কলকাতায় পুরসভা ও পোর্ট ট্রাস্টের তৎপরতায় বিসর্জনের পর কাঠামো তোলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু শহরের বাইরে গঙ্গার অন্যান্য প্রান্তে এমনকি শাখা নদীগুলির দিকে কি প্রশাসন নজর রেখেছে। সুদূর বিস্তৃত রাঢ় বঙ্গের অজয় ও দামোদর নদেও এখনও অনেক প্রতিমার কাঠামো ভাসছে। আরও বলা যায় গ্রাম বাংলার সুন্দর পুকুর, দীঘি জলাশয়গুলিও তো কত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানেও তো একইভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে। এর জন্য কেবল পুরসভা নয় পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যেও এন.এম.সি.জি এর এক নির্দেশিকা জারি করা দরকার।

প্রতিমা বিসর্জনের পর জলদূষণ নিয়ে প্রতি বছর বহু বিতর্ক, লেখালেখি হয়। বিভিন্ন মহল এমনকি প্রশাসন সজাগ হয়ে ওঠে। পরে আবার যা কে তাই হয়ে যায়। প্রতিমার গায়ে নানা বিষাক্ত রাসায়নিক রঙ ও অন্যান্য জৈব অভঙ্গুর যৌথ ভাবে জলে মিশে ভয়ানক জলদূষণ ঘটায়। যা বেশিরভাগ ভারি ধাতু দিয়ে তৈরি। সিসা, পারদ, নিকেল, ক্যাডনিয়াম, জিঙ্গ, কপার ইত্যাদি মিশে থাকে। মাটির মূর্তি, বাঁশ, ফুল, বেলপাতা, থার্মোকলের বিভিন্ন অলঙ্কার ও প্লাস্টিক ইত্যাদি জলাশয়ে মিশে নদীর নাব্যতা কমিয়ে জলদুষক পদার্থের গাঢ়ত্ব বাড়িয়ে তোলে। এই দূষিত জলের প্রভাবে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই সকল ভারী ধাতু জলের থেকে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রাণীকূলে প্রবেশ করছে। সেখান থেকে মানব দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মানব দেহে ধীরে ধীরে অ্যানিমিয়া, স্নায়বিক বৈকল্য, কিডনির রোগ এবং গর্ভস্থ ভ্রূণেও প্রভাব পড়ে। জলে বিভিন্ন ধরনের জলজ প্রাণী মাছ, শামুক, কাঁকড়া, ঝিনুক আক্রান্ত হয়। জলের উষ্ণতা যেমন একদিকে বেড়ে যায় অন্যদিকে বদলে যায় জলের ক্ষার অম্লমাত্রা। বেলপাতা, মালা, কলাগাছ ইত্যাদির পচনে জলের মধ্যে জীবাণুর ক্রিয়া বেড়ে যায়। উল্লেখ্য পুজোর মরসুমে গঙ্গার জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ক্রমশ কমে যায়। সকল জলজ প্রাণীদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিমা বিসর্জন, আবর্জনা ও নোংরা বর্জ্য নিক্ষেপনের কারণে গঙ্গা ও অন্যান্য নদী ও জলাশয়গুলো তাদের স্বচ্ছতা হারাতে বসেছে।

জলদুষণ নিয়ে প্রশাসনিক তৎপরতা অনেকাংশে দেখা গিয়েছে ঠিকই। ২০১০ সাল থেকে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদ প্রতিমা নির্মাণের সিসা, ক্যাডনিয়াম, মুক্ত রঙের ব্যবহারের কথা জানিয়েছিলেন। এই নিরিখে সেরা পুজোর পরিবেশ সচেতনতার ভিত্তিতে শারদ সম্মান দেওয়ার ঘোষণাও হয়েছিল। কয়েকটি পুজো বাদ দিয়ে তা কি আদৌও সফল হয়েছে? শিল্পীরা বছরের এই নির্দিষ্ট সময়ের পুজোতে প্রতিমা নির্মাণ করেন। তাঁদের জিনিসপত্রের দাম অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। জৈব রঙের কথা বলা হলেও তার দাম অনেক বেশি ভারি ধাতুর রঙের তুলনায়। সেক্ষেত্রে প্রতিমার দামও বৃদ্ধি পাওয়ায় কথা। আবার একইভাবে থার্মোকলের সাজসজ্জার তুলনায় পাটের সাজসজ্জার দাম বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীরা এই পথ বেছে নেন।

দিল্লির অনেক পুজোয় বিগত বহু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে পরিবেশ বান্ধব। তারা সিসামুক্ত রং দিয়ে প্রতিমাকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। তেমনই বিসর্জনের ক্ষেত্রেও তৈরি করা হয়েছে আলাদা জলাশয়। মণ্ডপ সজ্জাতেও অভিনব পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়েছে। পরিবেশ বান্ধব পাট ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে মণ্ডপ সাজানো হয়। ওই সব জায়গায় জৈব রঙ বিপুলভাবে ব্যবহার করা হয়। পুজো শেষে ফুল, বেলপাতা, মালা থেকে কম্পোট সার উৎপাদন হচ্ছে। আমাদের বাংলাতেও এমন পরিবেশ বান্ধব পুজো গড়ে তোলা দরকার। অনেক স্থানে এইভাবেই পুজো হয়। কিন্তু সর্বত্র এই ব্যবস্থা শুরু করতে পারলে সুস্থ আনন্দের মাত্রা বহুগুন বেড়ে যাবে।

পরিশেষে বলা যায় উৎসবের আনন্দ পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। পরিবেশ চেতনা আমাদের প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে। গঙ্গা সহ অন্যান্য নদী এমনকি গ্রামীণ জলাশয়গুলিকে দূষণমুক্ত করে তুলতে হবে আমাদেরই। নদীতে বিসর্জন দেওয়া যেমন বন্ধ করতে হবে তেমনি কেবল পুর এলাকায় নয় পঞ্চায়েত এলাকাতেও আলাদা জলাধার নির্মাণ করে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে। ভারতের জীবনের স্পন্দন গঙ্গা সহ অন্যান্য নদীগুলি। জনসাধারণের সচেতনতা ও প্রচেষ্টায় আমাদের প্রত্যেকটি উৎসব হয়ে উঠবে পরিবেশ বান্ধব।

লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Pollution Festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE