Advertisement
E-Paper

সিংহ খাবে পনির পকোড়া

সবাই জানে, আর যাতেই আঘাত করা যাক (যেমন বিরোধীর খুলিতে বা তলপেটে, লাঠি বা ত্রিশূল দিয়ে। সিনেমা হলের কাচে, আধলা ইট দিয়ে। লেখকের বুকে, বুলেট দিয়ে), ধর্মীয় ভাবাবেগে কক্ষনও আঘাত করা উচিত নয়।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৭ ০০:০০

সবাই জানে, আর যাতেই আঘাত করা যাক (যেমন বিরোধীর খুলিতে বা তলপেটে, লাঠি বা ত্রিশূল দিয়ে। সিনেমা হলের কাচে, আধলা ইট দিয়ে। লেখকের বুকে, বুলেট দিয়ে), ধর্মীয় ভাবাবেগে কক্ষনও আঘাত করা উচিত নয়। বরং ঠাটিয়ে পাটকেল ছোড়া উচিত নাস্তিকের যুক্তিপ্রত্যয়ে, মানবতাবাদীর নীতিতে, কাব্যরসিকের শিল্পভাবনায়, ভদ্রসমাজের মূল্যবোধে (ফেসবুকে চার অক্ষর পাঁচ অক্ষর ঝলসে লাখ লাখ গরীয়ান ধর্ম-মস্তান যা করে দেখাচ্ছেন)। ধর্ম কী? অভিধানবাজ বলবেন, যা ধারণ করে। কাঁচকলা। ধর্ম তা-ই, যা বারণ করে। ওই লোকটাকে ছোঁবে না, সেই জাতকে উপাসনাগৃহে ঢুকতে দেবে না, এটা পরলে এখানে আসবে না, সেটা খেলে ওখানে বসবে না, আমার বইয়ে যা লেখা আছে তাকে প্রশ্ন করবে না, আমার গুরু যে-নিদান দেবেন তা যাচাই করবে না, আমার যা পছন্দ হবে না তা তুমিও করবে না। ধর্ম ভক্তকে দেয় সেকেলে ও গোঁয়ারগেঁড়ে থাকার অধিকার, অন্যকে বেধড়ক অপমান করার অধিকার। ফুটপাত বা রানওয়ে, যা-ই চওড়া করতে যাও প্রকৃত ধার্মিক বলবে নাঃ শনিমন্দির বা মসজিদ সরাব না, ইঞ্জেকশন দিতে গেলে বিশ্বাসে দাপিয়ে বলবে এর চেয়ে জলপড়া ভাল, এ শিবের লিঙ্গে দুধ ঢেলে পুজো করবে কিন্তু ত্রিশূলের কাছাকাছি কন্ডোম লিখলেই খেপে বোম, ও মূর্তিপূজাকে এমন তেড়ে ঘেন্না যে ছাত্রদের হস্টেলে শ্রদ্ধেয় রাজনীতিকের মূর্তি অবধি ভাঙার হুমকি। ধর্ম এক অতুলনীয় অশিক্ষার নাড়ু। সিম্পলি হাত-ঘুরুঘুরু, ব্যস, চ্যাম্পিয়ন!

কিন্তু এগুলো পানসে কথা। অজানা ও উত্তেজক প্রশ্ন হল: সিংহ এখন খাবেটা কী? উত্তরপ্রদেশে কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, ঠিকই হচ্ছে, বৈধ না ওরা অবৈধ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কসাইখানায় যদি গরু মারা হয় তবে তো যে মারছে তার হাত-পা মুচড়ে ভেঙে দিতেই হবে। আর গরু যদি আমাদের মা হয়, মোষ নির্ঘাত বড়জ্যাঠা। ছাগল ছোটকা। মুরগি দূর সম্পর্কের ক্যাঁককেঁকে বড়পিসি। তাই শুধু গরু কেন, যে কোনও প্রাণী মারাই বন্ধ হোক, আমিষ খাওয়াটাই তুলে দেওয়া হোক। কেউ বলতে পারে, ঈশ্বরই আমাদের শ্বদন্ত দিয়েছেন, সে তো মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যই। কিন্তু ঈশ্বরের অভিপ্রায় সর্ব স্তরে মানলে তো উলঙ্গ হয়ে ঘুরতে হয়, আমরা তো প্যান্টালুন লড়াচ্ছি। এই মুহূর্তে যাঁরা ভারতকে শাসন করছেন তাঁরা যদি মনে করেন, নিরামিষ খাওয়াই ধর্মীয় ঔচিত্য, তবে গোটা দেশে আছড়াও: কম্পালসরি নিরামিষ। ঠিক যে ভাবে বিমুদ্রাকরণ হয়েছিল, রাতারাতি ঘোষণা: হে হিজিবিজবিজ ও বালকবৃন্দ, নাড়ো লেজ, কাল থেকে ভেজ। বাক্‌স্বাধীনতা ফলানো আঁতেলদের বিরুদ্ধে ‘যাক স্বাধীনতা’ ব্রিগেড লেলিয়ে দাও, ডজনখানেকের বেহ্মতালু আর জগদীশ বোসের খানদুই মূর্তি চুরচুরালেই প্রমাণিত হয়ে যাবে, মাংস খাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্তি নিজে নিতে পারে না, আর গাছের মোটেই প্রাণ নেই, তাই ডাঁটা চিবোলে প্রাণিহত্যার পাপ হয় না। অতএব সমস্যা যদি হয়: কসাইখানা বন্ধ বলে মোষের মাংস নেই, তাই চিড়িয়াখানায় সিংহকে মুরগি দেওয়া হচ্ছে, এবং তা তার মুখে রুচছে না— সমাধান: অপছন্দের খাবারই যদি দেবে, ঘাস দাও! বাঘ ও গরুকে এক ঘাটে জল খাইয়ে লোকে দাপটকীর্তি কিনল, আজ চড়কগাছ-নেত্র মেলে ন্যাট-জিও দেখুক, বাঘ-গরুতে এক ঘাসে কোঁদল (এই সর, আমি ঘাস চিবুব, তুই না)!

কেউ চিঁ-চিঁ বাগাতে পারে, সিংহ অত বোঝে না, শুধু প্রবৃত্তিতে চলে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সিংহ বলে তার ধর্মের আওতার বাইরে থাকার স্বাধীনতা থাকবে কেন? হিন্দুস্তানের সিংহ কি জন্মগত ভাবে হিন্দু সিংহ নয়? অ্যাদ্দিন তার একটা অভ্যাস জন্মে গেছে মানেই আজ দিগ্বিজয়ের প্রহরে সেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলতে হবে কেন? ধর্ম পালন করার দায় সিংহ যদি না অনুভব করে, তাকে ইলেকট্রিক চাবুক মেরে সবক শেখাতে হবে। যে ভাবে জোর খাটিয়ে অবিশ্বাসীদের, গরুখেকোদের শেখানো হচ্ছে, ভারতে থাকতে গেলে কোড অব কন্ডাক্ট কী। এগুলো তো বুনিয়াদি সত্য: যে-দেশে হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি, সে দেশে অন্য ধর্মের লোকেদের মাথা নিচু করে থাকতে হবেই; তেমনই, এ পৃথিবীতে মানুষের জোর বেশি (তার বন্দুক আছে), তাই অন্য প্রাণীকে মাথা নুইয়ে নিজ অধিকার সারেন্ডার করতে হবে। সিংহ সার্কাসে হাঁ-মুখের মধ্যে মানুষের মাথা নিয়ে স্টিল হয়ে থাকে, চোয়াল ব্যথা হলেও কপাৎ ক্লোজ করে না, তা হলে কড়া ট্রেনিং পেলে সে ঘাসপাতা খাবে না কেন? না, কেউই হৃদয়হীন নয়, সোমবার কচুর দম, মঙ্গলবার কুমড়োর ছক্কা, বুধবার আলু-ফুলকপি, এ ভাবে রুটিনে বৈচিত্র দেওয়া হবে। সোনামুখ করে পনির পকোড়া খেয়ে নিলে ল্যাবেঞ্চুস প্রাইজ দেওয়া হবে। যদি গায়ের জোর কমে যায়? থাবায় ত্রিশূল সেলোটেপ মেরে দাও, ফালাফালা!

কিন্তু এখন যুগ খতরনাক, ইন্টারনেটে কেউ গোমড়া সিংহ পোস্ট করে দিলে বিদেশিরা পিছনে লাগবে। তাই সিংহকে ‘হাসি-হাসি নিরামিষাশী, স্বেচ্ছায় পুঁইশাক ভালবাসি’ অ্যাটিটুড শেখাতে হবে। সার্জারি করে কান-এঁটো করা স্মাইল সেঁটে দেওয়া যায়। কিংবা ও যদি প্রতি গ্রাসের পর বলে ওঠে ‘জয় মোদী’? ময়না মানুষের ভাষা জপছে, সিংহ পারবে না? আরে বাবা, লিপ-টা নাড়ালেই হল। ব্যারিটোন নায়ককে দিয়ে প্লেব্যাক করিয়ে দেওয়া যাবে’খন!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy