Advertisement
E-Paper

ডেঙ্গিস্তান

বিপদ অকস্মাৎ আসিলে কর্তব্য নির্দিষ্ট করিতে, তাহা পালন করিতে ভুল হইতে পারে। কিন্তু এ রাজ্যে শিশুও জানে যে, বর্ষা আসিলে ডেঙ্গিও আসিবে।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০

পশ্চিমবঙ্গ এখন ডেঙ্গির মুক্তাঞ্চল। শিলিগুড়ি হইতে বারাসত, বর্ধমান হইতে নদিয়া, ঘরে ঘরে জ্বর, হাসপাতালে রোগীর স্রোত। সংকট যত তীব্র, ততই নিরুত্তাপ স্বাস্থ্য দফতর। ডেঙ্গির প্রকোপ কতখানি, কত জন জ্বরে আক্রান্ত, কত জন প্রাণ হারাইয়াছে, কোন এলাকাগুলি বিশেষ করিয়া বিপদগ্রস্ত, সে বিষয়ে সরকার মুখে কুলুপ আঁটিয়াছে। সরকার কেনই বা ব্যস্ত হইবে। প্রতি বৎসরই কয়েক হাজার লোক মশার কামড়ে কাবু হইবে, কয়েক ডজন ডেঙ্গিতে মারা যাইবে, ইহাতে আশ্চর্য হইবার আছেটা কী? সরকার বরং তরজা করিবে, ওই মৃত্যুগুলি ডেঙ্গি তাহার প্রমাণ কী? যেন ডেঙ্গি ভিন্ন অপর রোগে মরিয়া থাকিলে সরকারের আর দায় নাই। ঠিক এই ভাবেই উত্তরপ্রদেশে আদিত্যনাথের সরকার হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবকে শিশুমৃত্যুর কারণ বলিতে ঘোরতর আপত্তি করিতেছিল। এনসেফ্যালাইটিস কিংবা নিউমোনিয়ায় শিশুরা মরিয়াছে বলিলে সমস্যা নাই। সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা মাপিবার এমন বিচিত্র শর্ত কাহারা তৈরি করে? মৃত্যুর দায় এড়াইবার কাজটিই কি রাজধর্ম? উনিশশো তেতাল্লিশের মন্বন্তরে কলিকাতার পথে অভুক্ত মানুষের দেহ পড়িয়া থাকিত। কিন্তু বিলাতি প্রভুদের আজ্ঞায় তাহাদের ‘অনাহারে মৃত’ বলিবার উপায় ছিল না। সেই ধারা আজও অব্যাহত। তাই জ্বরের গায়ে ‘অজানা’ ছাপ পড়িয়াছে। ডেঙ্গির উল্লেখ না করিবার চাপ রহিয়াছে তাঁহাদের উপর, স্বীকারও করিয়াছেন অনেক চিকিৎসক।

পরিস্থিতিকে লঘু করিবার হীন প্রচেষ্টা সংকট তীব্র করিয়াছে। যে আপৎকালীন ব্যবস্থাগুলি লইলে রোগ নির্ণয় ও নিরাময় দ্রুত হইত, চিকিৎসা কার্যকর হইত, রোগীর প্রাণ বাঁচিত, তাহার কিছুই হয় নাই। অথচ এই বৎসর ডেঙ্গির নূতন বৈশিষ্ট্যগুলি কী, তাহার মোকাবিলা কী রূপে সম্ভব, তাহা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে নির্ণয় করিয়া, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীর মধ্যে প্রচার করা জরুরি ছিল। রোগীর কোন লক্ষণগুলি নিরীক্ষার প্রয়োজন, কোন নিয়মসূচি বা ‘প্রোটোকল’ মানিলে বিপন্মুক্তি হইবে, তাহার নির্দেশ সকল জেলা ও মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছনোর কথা ছিল। হয় নাই। তাই সরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গি-আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ ঘোষণা করিয়া ছাড়িয়া দিবার পর রোগীর দ্রুত অবনতি ও মৃত্যু হইতেছে। ইহা কি চিকিৎসাব্যবস্থার গাফিলতি নহে? রক্তপরীক্ষার ফল মিলিবার পূর্বেই দ্রুত অবনতি হইয়া প্রাণসংশয় হইতেছে রোগীর। রক্তপরীক্ষার সংখ্যা ও গতি বাড়াইতে বাড়তি কর্মী ও উপকরণ প্রয়োজন ছিল। অণুচক্রিকার দ্রুত হ্রাস এই রোগের লক্ষণ, তাই জরুরি ভিত্তিতে রক্তের উপাদানের জোগান বাড়াইতে হইত। এমন অনেক পদক্ষেপ প্রাণ বাঁচাইতে পারিত। সরকার ডেঙ্গির প্রকোপের ব্যাপকতা স্বীকার করিতে অসম্মত, তাই এই ব্যবস্থাগুলি নেওয়া হয় নাই।

বিপদ অকস্মাৎ আসিলে কর্তব্য নির্দিষ্ট করিতে, তাহা পালন করিতে ভুল হইতে পারে। কিন্তু এ রাজ্যে শিশুও জানে যে, বর্ষা আসিলে ডেঙ্গিও আসিবে। এ বৎসরও মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং ডেঙ্গির প্রাণঘাতী রূপে আত্মপ্রকাশ, দুটি বিষয়েই সংবাদমাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞেরা বার বার সতর্ক করিয়াছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তা ও পুরকর্তারা তাহাতে বিচলিত হন নাই। তাঁহাদের অনুমোদন না লইয়া রোগকে ‘ডেঙ্গি’ বলিবার সাহস করিবে কে? ক্ষুদ্র জীবাণু অবশ্য বৃহৎ নেতাদের রাজনীতির মহত্ত্ব বোঝে নাই। কোষের অভ্যন্তরীণ গঠনের রদবদল করিয়া নূতন রূপে তাহারা আসিতেছে। রোগীর দেহে সেই সকল জীবাণুর সংক্রমণ নানা অভিনব প্রকাশ পাইতেছে। অতএব পুরাতন লক্ষণ দেখিয়া ডেঙ্গিকে চিহ্নিত করা বাতুলতা। কিন্তু তাহা সরকারকে বুঝাইবে কে? আবহাওয়া বদলাইতেছে, জীবাণু বিবর্তিত হইয়াছে, কেবল নেতারা যথাপূর্বং। দেখিয়া শুনিয়া উটপাখিও লজ্জা পাইবে।

West Bengal Dengue ডেঙ্গি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy