Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাৎকার

‘পাচারে এগিয়ে এই রাজ্য’

এখন মনে হয়, এটারও হয়তো দরকার আছে। এই প্রচারটাকে কাজে লাগাতে হবে। লোকে জানলে তবেই সাহায্যের হাত বাড়াবে। যত হাত এগিয়ে আসবে ততগুলো বাচ্চা হয়তো বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে।

দিশারি: স্ত্রী সুমেধা এবং ২০০৭-এ উদ্ধার হওয়া মেহবুবের সঙ্গে কৈলাস সত্যার্থী

দিশারি: স্ত্রী সুমেধা এবং ২০০৭-এ উদ্ধার হওয়া মেহবুবের সঙ্গে কৈলাস সত্যার্থী

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৫৩
Share: Save:

প্রশ্ন: শহর তো ছেয়ে গিয়েছে আপনার ছবি দেওয়া হোর্ডিং-এ। কী মনে হচ্ছে?

কৈলাস সত্যার্থী: আমাকে ঠিক ‘আমি’ বলে মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতাদের মতো মনে হচ্ছে। তবে এখন মনে হয়, এটারও হয়তো দরকার আছে। এই প্রচারটাকে কাজে লাগাতে হবে। লোকে জানলে তবেই সাহায্যের হাত বাড়াবে। যত হাত এগিয়ে আসবে ততগুলো বাচ্চা হয়তো বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে। ততগুলো মেয়ে যৌনপল্লি থেকে বেরোতে পারবে। অনেক, অনেক কাজ বাকি! এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে আসার পথে কত বার গাড়ি দাঁড়াল ট্রাফিক সিগন্যাল-এ। রাস্তার ধারের ঝুপড়ির দোকানে কত বাচ্চাকে কাজ করতে দেখলাম! পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও ভাল নয়।

প্র: কতটা খারাপ বলে মনে হয়?

উ: যথেষ্ট উদ্বেগজনক। পাচারের ‘হাব’ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ। গ্রাম থেকে কখনও শিশুদের চুরি করা হচ্ছে। কখনও বাবা-মাকে টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েদের দূরে কোথাও বিয়ের নাম করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কখনও আবার ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন শহরে বাড়ির কাজের লোক হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। মেয়েদের যৌন ব্যবসায় নামানো হচ্ছে। আমরা দিল্লি, মুম্বই, পুনে, আরও নানা শহর থেকে যত মেয়েদের উদ্ধার করি, তার একটা বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গের।

প্র: অর্থাৎ এ রাজ্যে পাচারের কাজটা বেশ সংগঠিত ভাবেই হচ্ছে?

উ: অবশ্যই। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে এরকম কিছু এজেন্সি আছে, যেখানকার কর্মীরা বাঙালি। সকলে বাংলায় কথা বলেন। তাতে এ রাজ্য থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনার সুবিধা হয়। কারণ তারাও ভাবে বাংলা বলছে মানে এরা আমাদের নিজেদের লোক। বাচ্চারা, তাদের পরিবার এদের বিশ্বাস করে। তার পর ঠকে যায়।

প্র: এগুলো জানার পরে কখনও মনে হয়নি পশ্চিমবঙ্গে কাজ শুরু করাটা খুব জরুরি?

উ: অবশ্যই মনে হয়েছে। আমার দফতর থেকে আপনাদের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে চিঠিও গেছে। আমি দিদিকে খুব সম্মান করি। উনি অনেক ধরনের কাজ করছেন। চাই ওঁর সঙ্গে এ নিয়ে দেখা হোক, কথা হোক। দিদিকে জানিয়েছিলাম, আমি, আমার সংগঠন ওঁর পাশে আছি। গত বছর যখন এ রাজ্যে এসেছিলাম, তখনও আমার দফতর থেকে ওঁর দফতরে চিঠি লেখা হয়েছিল। এ বারও হয়েছে। আমার চার দশকের কাজের অভিজ্ঞতা। সেটাকে যদি এ রাজ্যে কোনও ভাবে কাজে লাগাতে পারি, তা হলে ভাল লাগবে।

প্র: উনি উত্তর দেননি?

উ: আমার কাছে কোনও উত্তর পৌঁছয়নি। উত্তর এলে আমার সংগঠনের কর্মীরা নিশ্চয় আমার কাছে পাঠাতেন। উনি নিশ্চয় খুব ব্যস্ত।

প্র: অর্থাৎ কৈলাস সত্যার্থী এ রাজ্যে তাঁর কাজের জন্য স্বীকৃতি পাচ্ছেন, কিন্তু এ রাজ্যে এখনও কাজটাই শুরু করে উঠতে পারেননি?

উ: না, একেবারে কাজ শুরু হয়নি তা বলা যাবে না। খুব ছোট আকারে শিলিগুড়িতে একটা অফিস খোলা হয়েছে। সেখানে দুজন কর্মী রয়েছেন। পাচার আটকাতে কাজ শুরু হয়েছে। চা বাগানগুলোর অবস্থা তো ভয়াবহ। এত অভাব। প্রচুর শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা থেকে পাচারকারীরা গিয়ে ওখানকার ট্রাইবাল বাচ্চাদের কিনে নিচ্ছে। তার পর বিভিন্ন জায়গায় বেচে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন:ভাইসাবের লড়াই লড়তে তিনি হতে চান বিচারপতি

প্র: বিভিন্ন জায়গা থেকে আপনারা যে শিশুদের উদ্ধার করেন, তাদের কোথায় রাখা হয়?

উ: উদ্ধারের পর নিয়ম অনুযায়ী সরকারি হোম-এ রাখা হয়। তার পর আইনি প্রক্রিয়া মিটলে অনেক সময় আমরা নিজেদের হোম-এও রাখি। আপাতত আমাদের তিনটি হোম রয়েছে। একটা দিল্লিতে, আর দুটো রাজস্থানে।

প্র: সরকারি হোম-এর কথা বলছেন। কিন্তু সেই সব হোম-এর বিরুদ্ধেও তো প্রচুর অভিযোগ?

উ: হ্যাঁ, নিরাপত্তার খুবই অভাব সরকারি হোমে। পেট ভরে খেতে দেওয়া হয় না। মারধর করা হয়। যৌন নির্যাতন চালানো হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ পাই। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হোম নিয়েও বিস্তর অভিযোগ আছে।

প্র: কোন কোন রাজ্যে আপাতত আপনার সংগঠন কাজ করছে?

উ: আপাতত ১৭টা রাজ্যে করছে। আমরা এটা আরও ছড়াতে চাইছি। আমি জানি, প্রত্যেক সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকা আছে। কিন্তু শিশুদের বিষয়টা সকলের ‘কমন’ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবেই এক দিন এ দেশ থেকে শিশু শ্রম, শিশু পাচার বন্ধ হবে।

প্র: আপাতত আপনার মূল লক্ষ্যটা কী?

উ: ‘হান্ড্রেড মিলিয়ন ফর হান্ড্রেড মিলিয়ন’। শুধু এ দেশে নয়, গোটা পৃথিবীতেই শিশুদের অবস্থা খুব খারাপ। অসম্ভব সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু আমার বিশ্বাস ১০০ মিলিয়ন শিশু যদি সঙ্কটে থাকে, তা হলে হাত বাড়িয়ে তাদের টেনে তোলার জন্যও ১০০ মিলিয়ন তরুণ আছে। অনেকেই কাজ করতে চায়। কিন্তু জানে না কী ভাবে করতে হবে। যেমন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এখন এত শক্তিশালী। তরুণ প্রজন্ম তো বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু তার অনেকটা অংশ জুড়েই থাকে সেক্স আর ভায়োলেন্স। থাকে কুৎসা। আমি সেই অভিমুখটাই ঘোরাতে চাই। ছাত্রছাত্রীরা ‘হিউম্যান ট্র্যাফিকিং’-এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক। এ রাজ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

প্র: কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাচ্ছেন?

উ: অনেকটাই পাচ্ছি। সরকারি কর্তারা আমার বক্তব্য ধৈর্য ধরে শুনছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের বদল আনতেও রাজি হচ্ছেন। কিন্তু যে দেশে প্রতি মিনিটে ১১জন শিশু নিখোঁজ হয়ে যায়, সেখানে আরও অনেক বেশি কাজ দরকার। আর সেটা সকলকে একসঙ্গে করতে হবে। অন্তত এই ক্ষেত্রে সরকার, বিরোধী দল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সকলকে এক হতে হবে। আমরা এক হতে পারি না বলেই আমাদের ঘরের বাচ্চারা এ ভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

প্র: অর্থাৎ আপনি সন্তুষ্ট নন একেবারেই?

উ: কী করে হব? ভারত গর্ব করে যে এ দেশে জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ ১৮ বছর বা তার কমবয়সী। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশুদের সুরক্ষায় জিডিপি-র মাত্র ৩.৭% খরচ হয়। ৪০ শতাংশের জন্য চার শতাংশও বরাদ্দ নেই। এই পরস্পরবিরোধিতাটা মারাত্মক।

প্র: নোবেল পাওয়ার পর কাজের পথটা নিশ্চয় অনেকটাই মসৃণ হয়েছে? আর্থিক সাহায্যের জন্য কোনও কাজ বোধহয় আটকে থাকছে না?

উ: হ্যাঁ, নোবেল-এর ট্যাগটা গায়ে লাগার পরে আমাকে অনেক মানুষ চিনেছেন। তাই দেশ-বিদেশের সাহায্য আসছে আগের চেয়ে বেশি। কিন্তু তাতেই সব কাজ হয়ে যাচ্ছে সেটা একেবারেই নয়। আসলে কাজের পরিধি তো অনেকটাই বেড়েছে। তাই টাকার দরকারও বেড়েছে। এই তো, বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেশ কিছু নোবেলজয়ীকে নিয়ে গত ডিসেম্বরে দিল্লিতে একটা সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম আমরা। সেখানে সকলেই শিশু শ্রম ও পাচারের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার বার্তা দিলেন। বুঝতেই পারছেন, এত বড় অনুষ্ঠান। গোটা বিশ্বের কাছে বার্তা পৌঁছেছে ঠিকই, কিন্তু জমানো টাকা অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে।

সাক্ষাৎকার: সোমা মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kailash Satyarthi Trafficking Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE