Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal Lockdown

পুলিশি প্রহারে ভাইরাস মরে কি

লকডাউন চলাকালীন পুলিশ কখনও ‘ফার্স্ট গিয়ার’-এ, তো কখনও ‘ফিফ্থ গিয়ার’-এ গিয়ে আইন প্রয়োগ করছে।

পুলিশ দিয়ে কোত্থাও করোনা ঠেকানো যায়নি। এই দেশ, এই রাজ্যেও যাবে না।

পুলিশ দিয়ে কোত্থাও করোনা ঠেকানো যায়নি। এই দেশ, এই রাজ্যেও যাবে না।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২০ ০০:০৩
Share: Save:

লকডাউন চলাকালীন একটি ভিডিয়ো এল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফাঁকা রাস্তায় পাশাপাশি শুয়ে আছেন বেশ কয়েক জন। দু’জন পুলিশ তাঁদের প্রবল লাঠির বাড়ি মারছে। দাবি, ‘ঘটনা’টি কলকাতারই। লকডাউন চলাকালীন রাস্তায় বেরিয়ে নিয়ম ভাঙায় শাস্তি! ভিডিয়োটি সত্যি না বানানো, জানা দুষ্কর। ফলে, দৃশ্যটিকে প্রতীকী ধরেই এগোনো যাক।

লকডাউন চলাকালীন পুলিশ কখনও ‘ফার্স্ট গিয়ার’-এ, তো কখনও ‘ফিফ্থ গিয়ার’-এ গিয়ে আইন প্রয়োগ করছে। দীর্ঘ লকডাউনের প্রথম দিকে বহু মানুষ জরুরি পরিস্থিতিতে বেরিয়েও পুলিশি ডান্ডার গুঁতো ‌খেয়েছিলেন। তখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করলেন। এক ধাক্কায় কলকাতা পুলিশের ক্ষিপ্র চিতার গতি শামুকের চাল হয়ে গেল! রাস্তায় স্বাভাবিক দিনের মতোই অজস্র গাড়ি, বাজারে ‘ডিসট্যান্সিং’ শব্দটিকে ডাস্টবিনে ছুড়ে বহু মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে মাছ কিনছেন। মাস্ক নেই অনেকের। কন্টেনমেন্ট এলাকায় পুলিশের সামনেই নিয়ম করে নিয়ম ভাঙা চলছে। দেশের বড় অংশে একই ছবি। দেখে মনে হয়, স্বাস্থ্য দফতর, বিশেষজ্ঞেরা কিছু নন, পুলিশেরই করোনা-র যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কোথায় কতটা অঞ্চলে কন্টেনমেন্ট হবে, এমন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন তাঁরা! ফলাফল? প্রত্যেক দিন আগের রেকর্ড ভাঙছে করোনা।

বছর শেষে টিকার আশা দেখে, আপাতত ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের রাশ টেনে ধরার চেষ্টায় আবার শুরু হল কড়া লকডাউন। রাজ্যেও ফের পঞ্চম গিয়ারে পুলিশ। আবার রাস্তায় ফেলে মার, কান ধরে ওঠবস। অনেকের মতে, এ দেশে নিয়ম ভাঙাটাই নিয়ম, তাই এমন ‘একুশে আইন’ প্রযোজ্য। সমস্যা হল, এই একুশে আইনের ‘স্টেরয়েড’ চাপিয়ে কিছু মানুষকে এক দিনের জন্য ঘাড় ধরে নিয়ম শেখানো যায়। কোটি কোটি মানুষকে নিয়মিত নিয়মনিষ্ঠ করা যায় না। কারণ, তাঁদের অধিকাংশকেই নিয়ম অবহেলার শিক্ষাটা দিয়ে রেখেছে রাজনৈতিক দল ও বৃহত্তর সমাজ। মাঝখান থেকে, বিশৃঙ্খল কয়েক জনকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ ঘটছে। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, প্রথম থেকেই নিয়মমাফিক প্রশাসনিক বন্দোবস্তের (প্রকৃত নিয়মভঙ্গকারীদের জন্য জেল জরিমানার আইনি প্রয়োগ) সঙ্গে সামাজিক সমাধানও জুড়ে রাখলে ভাল হত। তাতে হয়তো সুদূরপ্রসারী সুফল মিলত। যেমন, সরকার ক্লাবগুলিকে বছরে কয়েক লক্ষ টাকা দেয়। সেই ক্লাবগুলিকেই করোনা সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া যেত। হয়তো দুষ্টু ছেলেকে মনিটর করার মতো কার্যকর মডেলের প্রয়োগ হত। শুয়ে থাকা মানুষের উপর লাঠি চালানোর ভিডিয়ো প্রকাশের ফলে প্রশাসনকে সমালোচিত হতে হত না।

প্রসঙ্গত, আরও একটি প্রশ্ন উঠছে। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, দেশে প্রায় দু’কোটি মানুষ রাস্তায় থাকেন। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা অনেক বেশি। কলকাতায় পথবাসীর সংখ্যা কয়েক লক্ষ। তা ছাড়া, শহরে প্রায় পনেরো লক্ষ বস্তিতে থাকেন। তাঁদের অনেকের কাছে রাস্তাই বৈঠকখানা ও বিছানা! বেলগাছিয়ার বস্তিগুলিতে সংখ্যাটা এত বেশি যে, সবাই একসঙ্গে রাতে ঘরে ঘুমানোর জায়গাই পান না! ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঘরে ঘুমান! লকডাউনের ব্যাকরণ মেনে, তাঁদের সবাইকে ঘরে পাঠানোর চেষ্টা করলে, তাঁরা যাবেনটা কোথায়? লকডাউনের দিন কোথায় অদৃশ্য হয়ে যাবেন লক্ষ লক্ষ পথবাসী? কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকও কিন্তু অদৃশ্যই ছিলেন। তার পর তাঁরা মোদীর চার ঘণ্টার নোটিসে ডাকা লকডাউনের জাঁতাকলে পড়ে হাঁটতে শুরু করলেন রাস্তা, রেল লাইন, গলি, বনজঙ্গল ধরে। আর আমাদের দৃষ্টিপথ জুড়ে হঠাৎ যেন ছেয়ে গেলেন! কড়া লকডাউনের পাল্লায় পড়ে আগামী দিনে এই লক্ষ লক্ষ ফুটপাতবাসীও অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হয়ে উঠবেন না তো?

ক’বছর আগে শাংহাই এক্সপো-তে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, মূল শাংহাই শহর তো দূর স্থান, শহরতলি থেকেও যেন গরিব মানুষেরা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছেন! এক্সপো-র কোটি কোটি পর্যটকের কাছে যাতে শাংহাইকে পূর্বের ম্যানহাটন বলে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সম্ভবত তার জন্য! শাংহাই থেকে বহু দূরে বাস সফরে যেতে যেতে চিনা সাংবাদিক-বন্ধু দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে ওই মানুষদের মূল শহর থেকে কয়েকশো মাইল দূরে এনে রাখা হয়েছে!

আজ সারা দেশ জুড়েই চিনা দ্রব্য বয়কটের দাবি। তখনই এমন পুলিশি প্রকরণ প্রশ্ন তোলে, তবে কি আমাদের গণতান্ত্রিক দেশটির প্রশাসনের মনের গভীরেও একই চিনা মডেলের বসবাস? যেখানে মানুষ নিয়ম ভাঙছে বলে প্রশাসন ‘মনে করলে’, প্রকাশ্য দিবালোকে ওঠবস করিয়ে, চড়-থাপ্পড় লাঠি মারা যায়? এবং তা সমাজের একাংশের অনুমোদন পায়? মানবাধিকার কর্মীরাও বিশেষ রা কাড়েন না! যত ক্ষণ না আমরা প্রশাসন ও সমাজের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘চিনা’ ভাবনা সরাতে পারছি, তত ক্ষণ কয়েকটা সস্তা চিনা সামগ্রী বয়কট করে লাভ হবে না।

শুধু পুলিশ দিয়ে কোত্থাও করোনা ঠেকানো যায়নি। এই দেশ, এই রাজ্যেও যাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE