Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মমতাহীন

আশঙ্কা হয়, তাঁহাকে তাঁহার অহং চালাইতেছে। শুধু তো ডাক্তারদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নহে— এনআরএস-কাণ্ড রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হইয়া উঠিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

রাজ্যবাসী যাঁহাকে চিনিতেন, ইনিই কি সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? হিংস্র জনতার আক্রমণে মারাত্মক আহত এক জুনিয়র ডাক্তারকে যিনি দেখিতে যান না, অথচ কঠোর ভাষায় নির্দেশ দেন, চার ঘণ্টার মধ্যে কাজে যোগ না দিলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে? ইনিই কি সেই জননেত্রী, যে কোনও বিপদে সর্বাগ্রে মানুষের পার্শ্বে দাঁড়াইবার অভ্যাসটিই যাঁহাকে রাজনীতির শীর্ষে আনিয়াছিল? দুর্ভাগ্য, আজিকার মুখ্যমন্ত্রী সেই নেত্রীকে কোনও পথের বাঁকে ফেলিয়া আসিয়াছেন। এনআরএস-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী যতগুলি ভুল করিলেন, সেই জননেত্রী সম্ভবত তাহার একটিও করিতেন না। তিনি বুঝিতেন, হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশই সাধারণ ঘর হইতে উঠিয়া আসা কিছু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে, লরিবোঝাই গুন্ডার সহিত লড়িয়া যাওয়ার সামর্থ্য তাহাদের নাই। তাহারা ভয় পাইয়াছে, অসহায় বোধ করিয়াছে। হাসপাতালে কর্মবিরতির ডাক দেওয়ার মধ্যে অনৈতিকতা অনস্বীকার্য। আজিকার মুখ্যমন্ত্রী সেই অনৈতিকতা দেখিয়াছেন। অতীতের জননেত্রীর চক্ষে হয়তো এই ছেলেমেয়েগুলির অসহায়তাই সর্বাপেক্ষা বড় হইত। হাসপাতালে যত বড় গোলমালই হউক, তাহার মধ্যস্থতা করিতে মুখ্যমন্ত্রীকেই আসিতে হইবে, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বা নগরপালের উপস্থিতিও যথেষ্ট নহে— এই দাবিও অন্যায্য। কিন্তু, সেই অন্যায্যতাকে আপাতত না দেখিয়া মুখ্যমন্ত্রী দেখিতে পারিতেন, কতখানি অধৈর্য হইয়া উঠিলে ডাক্তাররা এমন অসম্ভবের দাবি করিতে পারেন। দাবিটি মিটাইলে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান কমিত না। বরং, রাজ্যবাসী জানিতেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভিতর এখনও সেই নেত্রী আছেন, যিনি নিজের কথা না ভাবিয়া বিপন্ন, আশ্রয়প্রার্থী মানুষের কথা ভাবেন, ভাবিতে পারেন। কী হইত, যদি পাঁচতারা হোটেলের উদ্বোধন বা কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনার অনুষ্ঠান কাটছাঁট করিয়া তিনি আসিয়া বসিতেন বিক্ষোভরত ডাক্তারদের পার্শ্বে? বলিতেন, তোমরা কাজ বন্ধ করিয়ো না, আমি দেখিব যাহাতে দুষ্কৃতীদের শাস্তি হয়, আর কখনও কোথাও এমন আক্রমণ না হয়? তাঁহার উপর মানুষের ভরসা বাড়িত বই কমিত না।

আশঙ্কা হয়, তাঁহাকে তাঁহার অহং চালাইতেছে। শুধু তো ডাক্তারদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নহে— এনআরএস-কাণ্ড রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হইয়া উঠিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী স্বপ্রবৃত্ত হইয়া খানিক নতিস্বীকার করিলে এই অচলাবস্থা কাটিত। সাধারণ মানুষের বিপন্নতাও যে তাঁহাকে নড়াইতে পারিল না, তাহা কি অহংয়ের কারণেই নহে? তাঁহার দিকে অভিযোগের অঙ্গুলি উঠিলেই তিনি শত্রু ঠাহরাইয়া লহেন। আগে সিপিআইএম-মাওবাদী বলিতেন, এখন বিজেপির জুজু দেখিতেছেন। আন্দোলনরত চিকিৎসকদেরও তিনি ‘বিজেপি’, ‘বহিরাগত’ বলিয়া চিহ্নিত করিতে চাহিলেন। দেখিলেন না, এই ছেলেমেয়েগুলিই প্রবল প্ররোচনা সত্ত্বেও এক বারও সাম্প্রদায়িক পথে পা বাড়ায় নাই, এক বারও বিজেপির সুরে সুর মিলায় নাই। বরং, দিলীপ ঘোষ হইতে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রত্যেককে ঠেকাইয়াছে। এখনও সময় আছে। মুখ্যমন্ত্রী বুঝুন যে তাঁহাকে প্রশ্ন করা, তাঁহার নিকট অভিযোগ করার অর্থ তাঁহার বিরোধিতা করা নহে। বহু অভিযোগের মধ্যেই প্রবল অভিমান থাকিতে পারে— প্রয়োজনের সময় মুখ্যমন্ত্রীকে পার্শ্বে না পাইবার অভিমান। কী ভাবে মানুষের পার্শ্বে দাঁড়াইতে হয়, নেত্রী মমতা জানিতেন। মুখ্যমন্ত্রী ভুলিয়া গেলেন কেন? তাঁহার অধীনে পুলিশ আছে, স্বাস্থ্যভবন আছে। জোর ফলাইবার উপায় তাঁহার আছে। অন্যের কথা শুনিবার খ্যাতিও তাঁহার তেমন নাই। কিন্তু এই একটি বার যদি তিনি নিজের অহংকে সরাইয়া সেই পুরাতন জননেত্রীর হাতে দায়িত্ব সঁপিয়া দেন, এখনও হয়তো পরিস্থিতি বদলাইতে পারে। সেই মমতাকে রাজ্য চেনে। সেই মমতাও রাজ্যটিকে চিনিতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NRS Hospital Mamata Banerjee Doctor's Strike
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE