Advertisement
E-Paper

আন্দোলনটা কী ও কেন

টানা ছ’দিনের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখেও কিছু প্রশ্ন জাগে। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? শুধু অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, না কি প্রধান শিক্ষিকাকেও অপদস্থ করে তাড়ানো? অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর পরেই কিন্তু আন্দোলনের তীব্রতা কমার বদলে বেড়ে গিয়েছিল একটিই দাবিতে। প্রধান শিক্ষিকাকে সরাতে হবে।

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৬:১০
গণ-আন্দোলন? জি ডি বিড়লা স্কুলের সামনে প্রতিবাদী অভিভাবকদের জমায়েত, ৫ ডিসেম্বর। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

গণ-আন্দোলন? জি ডি বিড়লা স্কুলের সামনে প্রতিবাদী অভিভাবকদের জমায়েত, ৫ ডিসেম্বর। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

রানিকুঠির স্কুলে চার বছরের মেয়েটির সঙ্গে ঘৃণ্য আচরণের যে অভিযোগ সামনে এসেছে তা সত্যি হলে নিন্দার কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন সূত্রে ঘটনার বিবরণ জেনে শিউরে উঠতে হয়। আমাদের শিক্ষা, রুচি, বিবেকবোধ সব বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। এ কোন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা! কারা আমাদের সহ-নাগরিক, পড়শি? প্রশ্নটা কিছু দিন ধরেই সকলকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

চার পাশে প্রায় রোজই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমাদের মনুষ্যত্বের ভিত নড়িয়ে দেয়। আমরা প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়তে পড়তে বেঁচে থাকা রপ্ত করতে শিখি। রানিকুঠির স্কুলের এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যেও আরও অনেক জায়গা থেকে যৌন হেনস্তার খবর এসেছে। কোথাও কোথাও অভিযোগ উঠেছে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও।

কিন্তু কিছু ঘটনার ধাক্কা চট করে সামলানো যায় না। যেমন, দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড। পরম সৌভাগ্য, জি ডি বিড়লা স্কুলের নিষ্পাপ শিশুটির তেমন মর্মান্তিক পরিণতি হয়নি। তবে যা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেটা আইনের বিচারে প্রমাণিত হলে তথাকথিত ‘মানুষ’ দেখে জানোয়ারেরাও ধিক্কার দেবে।

আশার কথা, জি ডি বিড়লা স্কুলের বিষয়টিকে এখনও পর্যন্ত কেউ ‘ছোট্ট ঘটনা’ বা ‘এ রকম তো কতই হয়’ বলেননি। পুলিশও মোটামুটি ‘চাপমুক্ত’ হয়ে কাজ করতে পারছে বলে মনে হয়। ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতে মামলা রুজু হয়েছে। তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনের বিধান অনুযায়ী দোষীর উপযুক্ত শাস্তি হবে, এটাই সবাই চাইবেন। এর কোনও অন্যথা নেই। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে গত কয়েক দিন ধরে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে স্কুলটির সামনে একটানা যা ঘটে চলল সেটাও কি সমর্থনযোগ্য? প্রাথমিক অভিঘাতে যে ভাবে বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল তাকে একেবারে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। স্কুলের মধ্যে এমন একটি কদর্য ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ ওঠার পরে ক্ষুব্ধ, শঙ্কিত অভিভাবকেরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি চাইতেই পারেন। তাঁদের সে জন্য খুব দোষ দেওয়া যায় না। এ কথাও ঠিক, প্রথম দিনে জি ডি বিড়লা স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষোভ দমনে প্রত্যাশিত ভূমিকা নেননি। অভিভাবকদের জোরালো প্রতিবাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষিকার আচরণে সে দিন বরং কিছুটা দায় এড়ানোর চেষ্টা চোখে পড়েছে। ঘটনার চার-পাঁচ দিন পরেও স্কুলের তরফে কেউ শিশুটির বাড়িতে গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখা কর্তব্য বলে মনে করেননি। সব মিলিয়ে ক্ষোভ সংগত কারণেই আরও বেড়েছে।

এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। কিন্তু ক্রমশ অভিভাবকদের ভিড়ের গায়ে যে ভাবে রাজনীতির ছিটে লাগানোর প্রয়াস শুরু হল, তাতেই নানা সন্দেহ দানা বাঁধে। এর পিছনে কোথাও কোনও সূক্ষ্ম রাজনীতির খেলা আছে কি? শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবার বোধহয় এ বার তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

রাজনীতি কাদের ‘শেষ আশ্রয়’, সে সম্পর্কে জর্জ বার্নাড শ’র পর্যবেক্ষণ ভোলা কঠিন। ইচ্ছায় -অনিচ্ছায় বিভিন্ন ঘটনার সংঘাতে বা নিত্য দিনের নানা অভিজ্ঞতায় তাঁর সেই নির্মম কথাগুলি সত্যি হয়ে আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। আমরা বার বার বুঝতে পারি, রাজনীতি বড় বিষম বস্তু। রাজনীতিকরা তার চেয়েও বিষময়। জল ঘুলিয়ে দেওয়া এবং সেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে যাওয়া—দুই ব্যাপারেই রাজনীতির কারবারিদের কৃতিত্ব সুবিদিত। রানিকুঠির স্কুলের ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে তেমন কোনও অভিসন্ধির আশঙ্কা হয়তো উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

টানা ছ’দিনের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখেও কিছু প্রশ্ন জাগে। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? শুধু অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, না কি প্রধান শিক্ষিকাকেও অপদস্থ করে তাড়ানো? অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর পরেই কিন্তু আন্দোলনের তীব্রতা কমার বদলে বেড়ে গিয়েছিল একটিই দাবিতে। প্রধান শিক্ষিকাকে সরাতে হবে।

ওই শিক্ষিকাকে আমি চিনি না। যাঁদের সন্তানেরা এত দিন ধরে ওই স্কুলে পড়ছে, তাঁরা নিশ্চয় চেনেন। ওই প্রধান শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা পেতেন কি না, অথবা তিনি কতটা ‘অভব্য, অসামাজিক, অদক্ষ’ সে সবও অভিভাবকেরাই ভাল বলতে পারবেন! কিন্তু তাঁকে সরানোর
দাবিটা হঠাৎ যে ভাবে জোরদার হয়ে ওঠে এবং যে কায়দায় তাঁকে সরানো হয়, তা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না।

‘সংগ্রামী অভিনন্দন’ শব্দবন্ধটি আমাদের জানা। প্রধান শিক্ষিকার অপসারণের ‘খুশি’তে ‘সংগ্রামী অভিনন্দন’ জানিয়ে ওই রাতে মিছিল করা নজর এড়ায় না। এমনকী, রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী যখন দাবি করেন, ‘‘আমরা আন্দোলনে জয়ী হয়েছি’’, তখন আরও বড় সন্দেহ দানা বাঁধে। একটি বিধিবদ্ধ কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব কী ছিল? আন্দোলনের শরিক হয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে তাড়ানো? তাঁকে কি সেই কাজে পাঠানো হয়েছিল? কী জবাব দেবে নবান্ন?

চার বছরের শিশুটির বয়ানে নির্যাতিত হওয়ার যে কথা জানা গিয়েছে তার ভিত্তিতে বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল দ্রুত। আজকাল সেটাই হয়। ফেসবুক, টুইটারে ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণা ও শাস্তির বিবিধ ‘বিধান’। এটা ভাল না মন্দ, সেই মূল্যায়নে যাব না। কিন্তু অবশ্যই বলব, সেই আন্দোলনের ধারাস্রোতে যাঁরা ওই স্কুলের দরজায় ভেসে এলেন, তাঁদেরও একাংশের ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না।

যেমন বিজেপি সাংসদ রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। রূপা হঠাৎ কেন স্কুলের গেটে গিয়েছিলেন? কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে? কেন জোর করে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন? অভিভাবকদের অনেকে তাঁকে চলে যেতে বলার পরেও কেন তিনি সারা রাত পথে বসে রইলেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে রানিকুঠির স্কুলের সামনে ‘হোক চিৎকার’ ব্যানার নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন কারা? কী উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের? যে সমস্যা ওই স্কুল এবং তার পড়ুয়া ও অভিভাবকদের ঘিরে, সেখানে সহসা ‘চিৎকার’ করতে বহিরাগতদের আবির্ভাবও কি একেবারে অকারণ?

প্রশ্ন অনেক। তবু সবচেয়ে ভাল খবর, অচলাবস্থা কাটিয়ে স্কুলটি আবার খুলল। প্রধান শিক্ষিকাকে স্কুল থেকে তাড়ানোর পরে এ বার সব কিছু ‘ঠিকঠাক’ চলবে, আশা করা যায়। স্কুলে পড়ুয়াদের সব রকম নিরাপত্তা সুনিশ্চিত রাখতে কর্তৃপক্ষ দায়বদ্ধ। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের গাফিলতি অবশ্যই ছিল। এ বার তা শোধরানোর পালা। নইলে কলঙ্কেরর দাগ মুছবে না। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে অভিভাবকদেরও একই সঙ্গে বুঝতে হবে, কোথায় থামতে হয়। ক্ষোভ-প্রতিবাদ সব ঠিক। কিন্তু কারখানার গেট আর স্কুলের গেট এক নয়। হতে পারে না।

Protest agitation G. D. Birla Centre for Education Parents Child Abuse Sexual Assault
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy