Advertisement
E-Paper

একটি প্রতিবাদী চিঠি আর তার পর পেরিয়ে আসা একশো বছর

একশো বছর আগে আজকের দিনে নাইটহুড ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ। তা থেকে কিছু কি শিখেছি আমরা? লিখছেন পারমিতা ভট্টাচার্যএকশো বছর আগে আজকের দিনে নাইটহুড ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ। তা থেকে কিছু কি শিখেছি আমরা?

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৯ ০৫:০০

১৯১৪ সালের মে মাস। মধ্যগগনে তখন ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সদ্য নোবেল সম্মানপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি। তার পাশাপাশি বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে ধুলোবালির অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বাতাসও! নোবেল প্রাপ্তির নেপথ্যে নাকি রয়েছে সুইডেনের রাজকুমারের ভূমিকা! এমনই ধারণা তখন ভারতের শাসকমহলের একাংশের। কবির নীরবতাই অবশ্য সে সবের উত্তর দিয়ে দিয়েছিল!

ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ইংরেজদের সম্ভ্রমের সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথের সময় থেকেই। দ্বারকানাথের পাণ্ডিত্য, বিচারবুদ্ধি, মেধা, রুচিবোধ আর সুদক্ষ ব্যবসায়িক মানসিকতাই তাঁকে সকলের কাছে বরেণ্য করে তুলেছিল। তিনি রাজা রামমোহনের মতাদর্শকে সমর্থন জানিয়ে চেয়েছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষাসভ্যতার আলো প্রবেশ করুক ভারতে। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে একাধিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্তও ছিলেন। পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে সম্মান জানান। রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর পিতামহ-পিতার উদারচেতা মনোভাব বহুলাংশে প্রভাব ফেলেছিল।

১৯১৪ সালেই শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অংশগ্রহণকারী পরাধীন দেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে, এমন প্রতিশ্রুতির ফলে সাধারণ ভারতীয়েরা যুদ্ধে অংশ নিলেন। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হলে শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের বেকার অবস্থায় নিজের নিজের গ্রামে পাঠিয়ে দিল! যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণে ভার্সাই চুক্তি নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত জাতিপুঞ্জের গঠন নিয়ে। এই সময় বঞ্চিত ভারতবাসীর মধ্যে পুঞ্জীভূত হতে থাকে শাসকবিরোধী তুষের আগুন। দেশে চরম আর্থিক মন্দা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে তখন। বড়লাট মন্টেগু-চেমসফোর্ড রাওলাট আইন করে শাসকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। ফলস্বরূপ ১৯১৯ সালের ১৩ মে পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড! নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষগুলোর উপর সশস্ত্র ক্ষমতাসীন বাহিনীর আক্রমণ!

সে ঘটনা মানুষের কানে পৌঁছতে সময় লেগেছিল খানিক। রবীন্দ্রনাথের কানে পৌঁছতেও বিলম্ব হয়েছিল। সংবাদপত্রের বিক্ষিপ্ত খবর, চিঠি ও লোকমুখে এসে পৌঁছয় ‘সভ্যতার মোড়কে বর্বরতা’র কথা। এহেন নৃশংস ঘটনায় কবি অস্থির হয়ে উঠে অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। পঞ্জাবে যে ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে একজন বুদ্ধিজীবীও প্রতিবাদ করবেন না, এটা কবির পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। তখন ব্রিটিশ প্রশাসন বাইরে থেকে কোনও লোককেই পঞ্জাব প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছিল না। কবি চেয়েছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী যদি রাজি থাকেন, তা হলে তাঁরা দু’জন দিল্লি গিয়ে পঞ্জাবে ঢোকার চেষ্টা করবেন। তাঁদের শাসকেরা গ্রেফতার করলে সেটাই হবে তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা। এই প্রস্তাব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড্রুজকে গাঁধীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করলেন। আর উপলব্ধি করলেন শাসকের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি গ্রহণের আগে গাঁধীর তাঁকে বলা উপদেশ আর ভবিষ্যৎবাণী। জাতিগত সাম্যদৃষ্টি বিষয়ে প্রায় একশো বছর ব্রিটিশ ধোঁকা দিয়ে এসেছে ভারতবাসীকে। গাঁধী এই মর্মেই সচেতন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু এই কথার মধ্যে তেমন কোনও যুক্তি তখন দেখতে পাননি কবি। কারণ, তিনিও চেয়েছিলেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত হোক তমসাচ্ছন্ন উপমহাদেশ।

অ্যান্ড্রুজের আনা সংবাদের প্রতীক্ষায় বসে রইলেন কবি। ফিরে এসে অ্যান্ড্রুজ জানালেন, গাঁধী এখনই পঞ্জাবে যেতে রাজি নন। শুনে কবি একটি কথাও না বলে নীরব হয়ে রইলেন। অথচ গাঁধীও তো এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন!

রবীন্দ্রনাথের সেই নীরববতাই জন্ম দিতে চলেছিল ঐতিহাসিক এক প্রতিবাদের ভাষার। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, ১৯১৯ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ বড়লাটকে একটি চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। সে চিঠিতে জানালেন, তাঁদের দেওয়া সম্মানিক ‘স্যার’ উপাধি তিনি ত্যাগ করছেন। সারা ভারতের মেরুদণ্ড যখন কঠোর শাস্তির ভয়ে শামুকের খোলসে নিজেদের বন্দি রেখেছে, তখন বাংলার এক কবির কলমে উচ্চারিত হয়েছিল নির্ভীক ধিক্কারবাণী। এক বিশ্বনাগরিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্পষ্ট প্রতিবাদ।

এই প্রতিবাদের পক্ষে-বিপক্ষে বয়ে গেল সমালোচনার ঝড়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমল হোমকে একটি চিঠিতে লিখলেন— ‘‘দেশের বেদনার মধ্যে আমরা যেন নতুন করে পেলাম রবিবাবুকে। এবার একা তিনিই আমাদের মুখ রেখেছেন।’’ আবার সমালোচনার বয়ানে শোনা গেল, তাঁর ওই উপাধি গ্রহণ করাই গোড়ায় গলদ ছিল এবং তা ত্যাগ করে তিনি নাকি প্রায়শ্চিত্ত করলেন। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ দেয়, এই সব সমালোচনা আর কটাক্ষের অনেক ঊর্ধ্বে ‘নাইটহুড’ পদবি ত্যাগ করে বড়লাটকে লেখা কবির চিঠিটি। শাসককের প্রতি তিনি অসম্মান দেখিয়েছেন, এই অজুহাতে তাঁকে কঠিন শাস্তি প্রদানও যে মোটেই অসম্ভব ছিল না, তা জেনেও প্রতিবাদ করতে বিরত থাকার কথা ভাবেননি তিনি।

মাঝে কেটে গিয়েছে একশোটি বছর। আমরা আজ যখন ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ পালন করতে ব্যস্ত, যখন কবির সেই সিদ্ধান্তের প্রতি প্রণত, তখনও বিশ্বের অবস্থা আদতে বদলায়নি বিন্দুমাত্র! ছবি মোটের উপর একই আছে, শুধু বদলে বদলে যাচ্ছে রং আর ক্ষমতাসীনের চেহারা!

আমাদের দেশেই কাকদ্বীপ থেকে কাশ্মীর— কোথাও নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়নি। তোষণ ও শোষণের নাগপাশ জড়িয়ে ধরেছে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে। কিন্তু আমরা? আমরা কি সাহসী হতে শিখেছি? সত্যিই কি পাঠ নিয়েছি কবির দেখানো পথে? মোটেই নয়। বরং আমাদের ভিতরের অসহিষ্ণু মন চোখ-কান বন্ধ করে সহিষ্ণু হয়ে উঠেছে!

(লেখক ইসলামপুরের মণিভিটা হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

Rabindranath Tagore Knight hood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy