Advertisement
E-Paper

শিক্ষকের রাজকীয় (অ)সম্মান

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘শিক্ষারত্ন’-র সন্ধান এবং তার পর নিজেদের ঝানু উদ্দেশ্য ও বিধেয়র সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘রাজ’ ভাব ও ভাষা প্রকাশে দড় শিক্ষকদের রাজকীয় ‘সম্মান’ প্রদর্শনে যত না বাঙালি শিক্ষকসমাজ সম্মানিত হচ্ছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কলুষিত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গন।

জ্যোতিপ্রসাদ রায়

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৮ ০০:২২

সম্প্রতি রাজকীয় উদ্যোগে জানা গেল, এ বৎসর ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কার পেতে হলে সংশিষ্ট দফতরে, সরকারি চাকরি পাওয়ার মতো ইচ্ছুক শিক্ষকদের দরখাস্ত করতে হবে। তার পর সেই আবেদন, প্রাথমিক ভাবে ঝাড়াই-বাছাই হওয়ার পর একটি তৃতীয় পক্ষের তদন্তের এলাকায় আসবে। এই নিরপেক্ষ(!) কমিটি নানা ভাবে সুলুক-সন্ধান করবেন, ‘শিক্ষারত্ন’ পেতে আগ্রহী আবেদক-প্রার্থী আদৌ এমন ‘ভূষণ’ লাভের যোগ্য কি না।

ভাবনা-পরিকল্পনা অতীব সাধু, কিন্তু এমন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকসমাজ তথা সুনাগরিকদের মনে ভেসে উঠেছে বেশ কিছু আনাড়ি ‘কথা’-মালা: (ক) কোনও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, নিজের পেশার গরিমা সম্পর্কে সচেতন শিক্ষক-শিক্ষিকা কি কোনও কালে ‘সম্মান’ পাওয়ার জন্য ‘ফেরি’ করেছেন? নাকি পদ-গরিমার দিক থেকে তাঁর এমন জীবন-প্রণালী শোভনীয়? (খ) বিগত বছরগুলিতে যাঁদের ‘শিক্ষারত্ন’-এ সম্মানিত করা হয়েছে, তাঁদের নির্বাচন ও যোগ্যতা নিয়ে কি কর্তৃপক্ষের স্ববিরোধী ত্রুটিপূর্ণ অবস্থান পরিস্ফুট হল না? (গ) যাঁরা তৃতীয় পক্ষ হিসাবে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচকের ভূমিকা পালন করবেন, তাঁরা কি অ-রাজকীয় মেজাজ ও শিরদাঁড়া সোজা রেখে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠিতে যথার্থ ব্যক্তিকে মনোনীত করার সৎ সাহস দেখাতে পারবেন? না কি ‘শিক্ষারত্ন’ পাওয়ার শর্তাবলিকে ‘খুড়োর কল’-এর মতো জনপরিসরে ঝুলিয়ে সামাজিক আবহে নিজের ‘রাজকীয়’-যোগাযোগের ক্যারিশ্মার দ্যুতি ‘অটুট’ রাখার সুপ্ত বাসনায় ‘বাবু’র বাড়িয়ে দেওয়া চিরকুটেই সই বুলিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন? ভেবে দেখেছেন কি, এই ভাবে আজ্ঞাবাহী হতে হতে শিক্ষিত বাঙালির ভিতর থেকে কেমন করে হারিয়ে যাচ্ছে সাদা-কালো’র ভেদ-জ্ঞান। এই ভাবে ‘রত্ন’ সন্ধানের মোড়কে বেড়ে যাচ্ছে না তো বিড়ম্বনার খাতায় আত্মলাঞ্ছনার অলিখিত ইতিহাস!

যে কোনও প্রকারের ‘সম্মান’-এর সঙ্গে যুক্ত থাকে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসার আন্তরিক স্পর্শ। তা পাওয়ার জন্য যোগ্য কিংবা যোগ্যতম ব্যক্তিকে কোনও দিন কোথাও উমেদারি, আবেদন, যোগাযোগ করতে হয়নি। বরং, নিজের কৃতির জোরে ‘রত্ন’-তুল্য হয়ে ওঠা এমন ব্যক্তিদের সম্মানিত করে কালে কালে গর্বিত হয়েছে কর্তৃপক্ষ। সমৃদ্ধ হয়েছে উন্নত রুচি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিবেশ। প্রকৃত সম্মাননীয় ব্যক্তি, কখনও ‘সম্মান’ পাওয়ার অলি-গলি জেনে কোনও কাজে অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই। প্রাত্যহিক অধ্যয়ন, কল্যাণমূলক চিন্তা-চেতনা, সামাজিক রুচির উৎকর্ষ সাধন, বাহুল্যহীন জীবনযাপন... এই সবই আবহমান কাল ধরে শিক্ষিত বাঙালির পরিচয়। নির্মোহ কাজের মাধ্যমে ‘রত্ন’ হয়ে ওঠা এমন বাঙালিকে খুঁজতে হয়নি তথাকথিত দরবারি স্বীকৃতির পথ। তিনি মহাকালের দরবারে স্বীকৃত হয়েছেন ‘অমূল্য’ রত্ন-রূপে।

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘শিক্ষারত্ন’-র সন্ধান এবং তার পর নিজেদের ঝানু উদ্দেশ্য ও বিধেয়র সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘রাজ’ ভাব ও ভাষা প্রকাশে দড় শিক্ষকদের রাজকীয় ‘সম্মান’ প্রদর্শনে যত না বাঙালি শিক্ষকসমাজ সম্মানিত হচ্ছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কলুষিত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষকদের মধ্যে পঠন-পাঠন, বিদ্যাচর্চা, অধ্যয়ন... এই রুটিন কাজের থেকেও গুরুত্ব পাচ্ছে ‘শিক্ষারত্ন’-র দৌড়ে নাম লিখিয়ে কী ভাবে চূড়ান্ত নির্বাচন কিংবা মনোনয়নে টিকে থাকা যায়— সেই মহার্ঘ ছক ও ছক্কার সুলুক-সন্ধান। অন্য দিকে জনগণের টাকায় শিক্ষকসমাজের প্রতি ‘ভানুমতীর খেল’ দেখানো উদার রাজকীয় ‘সম্মান’ প্রদর্শনের সুচারু প্যাকেজে বাঁধা থাকে ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখার রকমারি পাটিগণিত, দল বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্যের মাথা-বৃদ্ধির সুশোভন নকশা। প্রতি দিন ‘সাধারণ’ জীবনচর্চা দেখতে দেখতে ছাত্রসমাজের মন থেকে মুছে যাচ্ছে শিক্ষকের যাবতীয় ‘অ-সাধারণত্ব’ সম্পর্কে সম্ভ্রম। অন্য দিকে রাজকীয় পরিসরে এই বার্তা ক্রমে জোরদার হচ্ছে, যে কোনও কৌশলে ‘ভাত’ ছড়ালে একদা ‘সমাজ-বিবেক’ হিসাবে চিহ্নিত আপসহীন ‘জাতির মেরুদণ্ড’কে অতি সহজেই প্রয়োজনের ‘উঠোনে’ প্রচার-গীতের আসরে নামিয়ে আখের গুছানো যাবে।

যখন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া ‘শিক্ষারত্ন’রা সম্মানের ‘প্রাপ্তি’ আর ‘অর্জন’-এর ভেদাভেদ বুঝতে পেরে, ফাউ পাওয়া খেতাব, পুরস্কার... সব কিছু পরিত্যাগ করে ‘রত্ন’-এর চাকচিক্যহীন ছাপোষা মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদাময় সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য নির্মোহ শিক্ষকের স্তরে উত্তীর্ণ হতে চেষ্টা করবেন কৃতির মাধ্যমে, তখন বুঝতে পারবেন অদৃশ্য রাজকীয় চোরাটান। তখন কেবল স্নায়ু’র স্পন্দনে স্পন্দনে অদৃশ্যে সঞ্চারিত অসহায় বেদনাবোধ: প্রভু কেন নষ্ট হয়ে যাই...?

কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে
বাংলার অধ্যাপক

Education West Bengal Award Teacher
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy