আঠারো দিন অতিক্রাম্ত, ভারত ও চিনের সেনা মুখোমুখি যুযুধান দাঁড়াইয়া। পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা ফিরিবে কবে, এখনও তাহার দিশা নাই, বরং দিল্লির কথাবার্তায় সংঘর্ষপরায়ণতার ভাব স্পষ্ট। প্রতিরক্ষার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অরুণ জেটলি যে মন্তব্য করিয়াছেন, তাহাতেও সংঘাত মিটাইবার অপেক্ষা বাড়াইবার ইচ্ছাটিই বেশি ফুটিয়া উঠিয়াছে। ভুটান সীমান্তে একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করিয়া ভারতীয় সেনা এবং পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) দুই পক্ষেরই অভিযোগ, অপর পক্ষ আন্তর্জাতিক সীমান্ত অমান্য করিতেছে। ফলাফল: দুই পক্ষই ঠায় দাঁড়াইয়া পরস্পরের রক্তচাপ বাড়াইতেছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ছায়াযুদ্ধের আবর্তে ঢুকিয়া গিয়াছে ভুটানও। অতি ক্ষুদ্র সেনা-সংবলিত, নিজের প্রতিরক্ষায় প্রায় অসমর্থ, অবিসংবাদিত ভাবে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের উপগ্রহ-সমান এই ভূখণ্ডবেষ্টিত দেশটি এত দিন নিজের ভালমন্দ বিনা তর্কে ভারতের উপরই ছাড়িয়া দিয়াছিল। চিনের উপর তাহারা বিশেষ নির্ভরতা দেখায় নাই। অথচ এই মুহূর্তে ভারত-চিন উত্তাপ-বলয়ে ভারতের সেই পরমমিত্র ভুটানও অবস্থাগতিকে দ্বিশক্তি সংকটে হাবুডুবু খাইতেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মিত্রহীন পরিবেশে এমন বন্ধুও যদি হাতছাড়া হইয়া যায়, তাহা সুসংবাদ হইতে পারে না।
দিল্লির কূটনীতি-বলয়ের পক্ষে ইহা একটি বিশাল পরাজয়। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর অন্যতম গুরুতর কূটনৈতিক ভ্রান্তি হিসাবে ইহা গণ্য হইতে পারে। এমনিতেই পাকিস্তান এবং ‘এক বলয় এক রাস্তা’ (ওবর) সূত্রে চিন-ভারত অশান্তি এখন তুঙ্গে। তাহার মধ্যে দিল্লি সম্পূর্ণ একটি ‘না-বিষয়’কে লইয়া বাড়াবাড়ি শুরু করিল। চুলকাইয়া ঘা করাও নহে, বলা চলে, শূন্য হইতে ঘা আমদানি করিল। বিতর্কিত সীমান্ত ভূখণ্ডটি সরাসরি ভারতের মাটিতে নহে, ভুটানের মাটিতেই, সুতরাং— ভুটান ও চিনের ১৯৯৮ সালের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক শান্তি বজায় রাখিবার শর্তে আবদ্ধ, তাহা মনে রাখিয়াও— দিল্লির এতটা আক্রমণাত্মক হইবার প্রয়োজন ছিল না। কেবল সীমান্তে সেনা মোতায়েন নয়, কূটনৈতিক বার্তাগুলিতেও দিল্লি প্রবল আক্রমণাত্মক। সীমান্তের অশান্তি না মিটিলে না কি ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদানও থামিয়া যাইবে। অথচ ভারত-চিন অশান্তি আজ অনেক কালের বাস্তব, ১৯৬২ সালের যু্দ্ধের পর এক দিনের জন্যও সীমান্ত-সংকটের মীমাংসা হয় নাই, তাহার মধ্যেই অন্যান্য সম্পর্ক এত দিন যেমন চলার চলিয়াছে। আজ হঠাৎ অকারণ কয়েক পা আগাইয়া খেলিবার দরকার ছিল না।
এই আক্রমণমুখী সামরিক নীতি যদি নরেন্দ্র মোদী সরকারের সচেতন পদক্ষেপ হয়, তাহা হইলে বলিতে হয়, আরও এক বার কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা মাথায় রাখিয়া জাতীয় কূটনীতি প্রণয়ন করিতেছে। মনে করিতেছে, নব্য জাতীয়তাবাদের হিসাব অনুযায়ী এ বার সব ব্যাটাদের মুণ্ডগুলি চাঁচাই হইল প্রধান কাজ। সেনাপ্রধান বিপিন রাবত আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে অবতীর্ণ। সিকিমে গিয়া তিনি যে ভাবে আগ্রাসী বার্তা প্রচার করিলেন, তাহাতে ভারতের কোনও লাভ তো হইলই না, চিনের লাভটি হইল জব্বর। ভারত যে প্রয়োজনে আড়াইখানা ফ্রন্টে লড়িবার জন্য প্রস্তুত (অনুমান করা যায়, পাকিস্তান, চিন ও কাশ্মীরের কথাই হইতেছে)— তাহা বিশ্বদরবারে আগাম ঘোষণা করিয়া দিল্লি প্রমাণ করিল, তাহারা সংকট মিটাইবার অপেক্ষা সংকট মোকাবিলার জন্যই বেশি প্রস্তুতি লইতেছে। এই পৌরুষসর্বস্ব কূটনীতি দিয়া আর যাহাই হউক, দেশের মুখ উজ্জ্বল করা যাইবে না। অবশ্য মোদী সরকারের তেমন কোনও লক্ষ্যও নাই, বিজেপির কাঁচা ও মূর্খ মতবাদের মুখ উজ্জ্বল করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ও বিধেয়।