শোনা দরকার। জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান, কলকাতা। জুলাই ২০১৬। ছবি: বিশ্বরূপ দত্ত
মেডিক্যাল কলেজের ক্লিনিকাল ক্লাসরুমে ‘মেথড’ পড়াচ্ছেন শিক্ষক, নিবিষ্ট মনে। অনেকটা সেতার কিংবা এসরাজ বাদক যে রকম সুর ভাঁজেন। ছাত্রছাত্রীদের বোঝাচ্ছেন, কী ভাবে রোগীদের নিরীক্ষণ করা উচিত, মাথা থেকে পা পর্যন্ত কী কী দেখা দরকার, কী কী দেখতে পেলে কী কী ভাবা প্রয়োজন এবং কী ভাবে সব ভাবনাকে একসূত্রে গেঁথে মালা তৈরি করতে হয়। রোগের কারণ নির্ণয় করতে গেলে ডাক্তারদের ধাপে ধাপে এগোতে হয়, প্রমাণ এবং উপাদান জড়ো করতে হয় এবং তা করতে হয় সুনিপুণ দৃষ্টির সঙ্গে। তাতে একাগ্রতা লাগে, নিষ্ঠা লাগে, আর রোগীর কষ্টের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতে পারলে তা আরও ভাল করে করা যায়। ‘ভাল চিকিৎসক সে-ই হবে, যার ঈগলের চোখ, পিতার স্নেহময় হৃদয় আর মায়ের মতো হাতের ছোঁয়া।’
শিক্ষক শেষ করার আগেই উঠে দাঁড়ায় তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র, তার দু’চোখের দীপ্তি ঢাকা পড়েছে উদ্বেগের মালিন্যে। সে বলে ওঠে, ‘হবে না স্যার, নতুন পথ বাতলান। হাত দিতে পারব না রোগীর গায়ে! জেলে যেতে হবে।’ থমকে দাঁড়ান শিক্ষক, থমথমে ক্লাসরুম। ছেলেটি বলে চলে, ‘বাবার স্নেহও এখন ঈগলের চোখে অপবিত্র। পিতার হৃদয় চাপা পড়ে জেলের গরাদের পেছনে। নিজেকে বাঁচানোটাই সব থেকে জরুরি স্যার! এ রকম জানলে এ ডাক্তারি পড়ায় আসতাম না।’
কথাগুলো শুনতে কারওই ভাল লাগবে না, উত্তরও নেই কারও কাছেই। বিবেকের মতো শোনালেও এটাই এই মুহূর্তে এ রাজ্যের, এ শহরের আতঙ্কগ্রস্ত চিকিৎসকদের না-বলা কথা। বাচ্চারা সত্যি কথা বলে ফেলে তাড়াতাড়ি, বড়রা চারপাশে অনেক তাকায় বলার আগে। বার বার ভাবে কী বললে আমিও বিপদে পড়তে পারি। এই ভাবনাতেই ‘প্রতিষ্ঠা’র দিনাতিপাত চলে। পেটানো, মাথায় ঘোল ঢেলে শহর ঘোরানো, নাক-কান মলে দেওয়া ইত্যাদি নানান কিসিমের শাস্তির নেট প্র্যাক্টিসের পর পিতা কিংবা পিতৃব্যতুল্য চিকিৎসককে ‘স্পর্শ দোষে’ দুষ্ট বলে জেলে পাঠানো গেছে। রোগী দেখার পদ্ধতি নাকি যথেষ্ট সম্ভ্রম সমৃদ্ধ এবং সংযত ছিল না। অতএব, বিধির রাশ এবং রাশি যাদের হাতে, তাঁরা আলোড়িত হয়েছেন। বিধান দিয়েছেন। তা শিরোধার্য করেই কয়েকটি কথা বলা দরকার।
‘ডাক্তারকে দেখে নেব, ফাঁসিয়ে দেব’ ইত্যাদি শুনতে অনেকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বোঝাপড়ার যে অদৃশ্য বাঁধনে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক তৈরি, তা যেন এ রাজ্যে অন্তত হঠাৎ করে এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, যুক্তিহীনতা, অভব্যতার পাথরে চাপা পড়েছে। এক একটি ঘটনা, কিন্তু পরের প্রশ্নগুলো অনেক ব্যাপক। তা ব্যক্তি-চিকিৎসকের কষ্টের এবং অসম্মানের থেকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায় আমাদের সবাইকে। চিন্তায় ফেলে চিকিৎসক-রোগীর আগামী সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে।
চিকিৎসকরা যদি নিজেরাই আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে শুরু করেন, আগে নিজেকে বাঁচাই, তার পর রোগীর কথা ভাবা যাবে, তাতে কার লাভ? এ রকমই একটা ভাবনার ক্ষেত্রভূমি আমরা তৈরি করছি নাকি? রোগীর জীবন বাঁচাতে গেলে কিংবা রোগ নির্ণয় করতে গেলে অনেক সময়ই চিকিৎসককে বেশ কিছু সাহসী এবং আপাতদৃষ্টিতে স্পর্শকাতর পদক্ষেপ নিতে হয়। তা করতে গিয়ে যদি প্রতি মুহূর্তে ভাবতে হয় যে, এতে যে আমি ফেঁসে যেতে পারি, তাতে তো ডাক্তার তাঁর ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হবেন। চিকিৎসককে যেমন রোগীর শিক্ষা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং মানসিক গঠন খেয়াল রাখতে হয়, তেমনই এটাও বোঝা দরকার প্রত্যেকের যে, আয়না দিয়ে শরীর দেখে চিকিৎসা করা যায় না। যদিও বা কোনও মুহূর্তে সাধারণ মানুষ ভুল বোঝেন, তা ঠিক করার দায়িত্ব ও দায় প্রশাসনের। আইনরক্ষকদেরও মাথায় রাখা দরকার যে, চিকিৎসা পেশার সংবেদনশীলতা অনুযায়ী বিশেষ নিয়মনীতি, বিধান আর বিচারের ক্ষেত্রও আছে।
পরিকল্পিত ও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হওয়া গণ-উন্মাদনায় যদি প্রশাসন প্রভাবিত হয়, তা হলে চিকিৎসকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ আরও বাড়ে। এই মুহূর্তে তা এই রাজ্যে প্রকট। অধিকারবোধের ধারণা সমাজে প্রসারিত হোক, তা অবশ্যই চাই। রোগীর সম্ভ্রম রক্ষার দায়ও চিকিৎসকের থাকুক, সেটাও জরুরি। কিন্তু যেটা চিন্তার, তা হচ্ছে, অধিকার সম্পর্ক স্বচ্ছতা না থাকার ফলে সাধারণ মানুষ বহু ক্ষেত্রেই চরম অস্বচ্ছ, কিছু মধ্যস্বত্বভোগীর ছড়ানো বিকৃত তথ্য ও তার বিশ্লেষণে প্রভাবিত হয়ে পড়েন।
চিকিৎসা কেন্দ্র ও চিকিৎসকদের ওপর যত আক্রমণ এবং কালি ছোড়ার খেলা হয়, তাতে দেখা গেছে যে, এই অদৃশ্য, সামাজিক ‘ক্ষমতাবান’রাই পিছন থেকে সক্রিয় থাকেন। বার বার সেটাই ঘটে, চিকিৎসকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে পড়েন যূথবদ্ধ, অযৌক্তিক হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মসৃণ, অসহায় শিকার। এই প্রবণতা কি খুব মঙ্গলের? কথাটা ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
চিকিৎসদেরও অবশ্যই ভাববার যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের একটা বিচ্ছিন্নতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকেই শুধু নিজেরটুকু, আরও বেশি নিজেরটুকু ভাবতে ভাবতে চিকিৎসকদের নিজস্ব যে ‘এজেন্সি’, তাও সামাজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্যই রাস্তায় নেমে, আস্তিন গুটিয়ে পাল্টা তাড়া করা চিকিৎসকদের পেশার ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু এটা উপলব্ধি করা দরকার যে, সামাজিক অসহিষ্ণুতার ঢেউ যে পেশাগুলিকে সব থেকে আগে আঘাত করছে, তার মধ্যে চিকিৎসা অগ্রগণ্য। তাই যূথবদ্ধ হিংসা আর পরিকল্পিত দ্বেষের বিরুদ্ধে সঙ্ঘশক্তি বাড়ানো দরকার। আজ ওর বাড়ি পুড়ছে, কাল কিন্তু আমারটা! আর আগুন নেভাতে গেলে মানুষকেই সঙ্গে লাগবে। তারা ‘কেস’ নয়, ‘পেশেন্ট পার্টি’ও নয়।
চিকিৎসক, লিভার ফাউন্ডেশন-এর সচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy