Advertisement
E-Paper

‘ভারতমাতা’র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের ভারতে মনুর কথা এমন ফলে যাবে কে জানত!

আশিস পাঠক

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৮ ১৬:৫৮
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১)

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১)

সেই দক্ষিণের বারান্দাটা তখন নীরব হতে বসেছে৷ বড়দাদা গগনেন্দ্রনাথ রাঁচী বেড়াতে গিয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন৷ নির্বাক, নিশ্চল হয়ে রইলেন বাকি জীবনটা৷ অবনীন্দ্রনাথও তখন ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন৷ রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেন, কী হলো অবন, ছবি-আঁকা ছেড়ে দিলে৷ অবনীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কী জান রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করি তাই এঁকে ফেলতে পারি, সেইজন্যেই চিত্রকর্মে আর মন বসে না৷ নতুন খেলার জন্য মন ব্যস্ত৷’

সে খেলা যাত্রাপালার খেলা৷ নাটকে অভিনয় অবনীন্দ্রনাথ সেই জোড়াসাঁকোর তরুণ আলোতেই করেছেন বহু৷ যে-বাল্মীকি-প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন বাল্মীকি, তাতেই ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ডাকাত৷ ডাকঘরে সেজেছিলেন মোড়ল৷ কিন্তু এ নাটক নয়, যাত্রাপালা৷ তা-ও একেবারে খেয়াল-খুশির যা-তা যাত্রাপালা৷ আর তার মুখ্য অবলম্বন রামায়ণ৷

রামায়ণ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ভাবছেন তিনি৷ ভাবছেন একেবারে উল্টো করে৷ পালা লেখারও আগে, নানা রকম পুঁথি লিখছেন রামায়ণ নিয়ে৷ বীর হনুমান সেখানে কাজ-পালানো, অলস৷ মারুতির পুঁথি-তে তিনি চলেছেন কিষ্কিন্ধ্যায়, মতং মুনির কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে৷ কিন্তু ‘পথ চলতে আর মন চায়না পবন-পুত্রের৷ ইচ্ছা করে এই সব গাঁয়ের এখানে থেকে যাই— ফলও প্রচুর ছায়াও মেদুর/বসলেই হল বিছায়ে মাদুর,/কে আর যায় কিষ্কিন্ধ্যায়— অতদূর! চলতে চলতে কোনখানে দেখা যায়— একটি কুয়োতলা, একটি বটগাছ, একটি কালো কোলো পল্লীবালা, পোড়ো মন্দির, ইষ্টকালয়, দেখে হনুমানেরই মন খারাপ হয়ে যায়, মানুষ তো দূরের কথা—এমন সুন্দর সেসব স্থান৷’

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ উনিশ শতকে জন্মগ্রহণ করা এক বৃদ্ধের চলে যাওয়া নয়

এ পুঁথি রামায়ণের নয়, একেবারে আমাদের ঘরের কথার পুঁথি৷ ‘সত্য ত্রেতা দ্বাপর, তারপর কলির তিপ্পান্ন হাজার বচ্ছর গতে গন্ধমাদন পর্ব্বত ক্ষয় পেতে পেতে হয়ে পড়েছে যখন মরুত্তাশ্রমের চাঁই-বুড়োর ঠেসান দেবার গের্দ্দাটি, সেই কালে আশ্রমের ভোগমণ্ডপের সামনে গাঁজাল-কুঞ্জে জোড়া-পেঁপেতলায় সেই গন্ধমাদনের সামনে আসন পেতে বসে চাই-বুড়ো মারুতির পুঁথি পাঠের পূর্বেব গণ্ডূষ করছেন আর মন্ত্র পড়ছেন...’৷

১৩৪৪-’৪৫ বঙ্গাব্দের মৌচাক পত্রিকায় মারুতির পুঁথি যখন প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক, তখনই একটি গোপন খাতাও তৈরি হয়ে উঠছে অবনীন্দ্রনাথের, ‘খুদ্দুর যাত্রা’ বা ‘খুদি রামলীলা’-র খাতা৷ নিজের মতো এক রামায়ণ লিখে চলেছেন তিনি সেখানে৷ তার মধ্যে তৈরি হয়ে উঠছে তাঁর নিজের তৈরি কাল্পনিক চরিত্র হাঁচি-টিকটিকি, তাল-চড়াই, ঢেঁকি, ভোম্বল, বুড়ন, বনমানুষ, মেটেভূত, জলসাভূত, মহামারি কিংবা আদিমধ্যিঅন্তি৷

অলংকরণ: অবনীন্দ্রনাথের ‘খুদ্দুর যাত্রা’ থেকে নেওয়া।

কিন্তু এ কি কেবল ছেলেভুলানো খেলা? নয় যে, সেটা বোঝা যায় এই রামায়ণে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজেরই করা অলংকরণে৷ এত কাল ছবি এঁকে অলংকরণ করতেন তিনি৷ এ বার করতে চাইলেন ছবি সেঁটে৷ নিজের আঁকা ছবি নয়, খবরের কাগজ বা পাঁজি থেকে কেটে নেওয়া ছবি, কিংবা দেশলাইয়ের বাক্সের ছবি৷ আর এমন আপাত-উদ্ভট ভাবে ছবিগুলি লেখার সঙ্গে সেঁটে দেন যে রামায়ণের আর একটা মানে তৈরি হতে থাকে৷ রাবণের দরবার বোঝাতে পাশে সেঁটে দিয়েছেন ফুটবল-শিল্ডের চারপাশে বিদেশি খেলোয়াড়দের মুখ৷ সীতাকে খোঁজার জন্য হনুমান যখন আয়োজন চালাচ্ছেন তখন তাঁর পাশে সংবাদপত্র থেকে কেটে নেওয়া হেডিং, সাম ইনফরমেশন নেসেসারি৷ পঞ্জিকার পাতা থেকে কাটা লঙ্কার ছবি অনায়াসে চলে এসেছে লঙ্কাকাণ্ড শুরুর সময়৷ আর এই নতুন রামায়ণে মকরাক্ষ রাম-বাহিনীর গরু-ভক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ-কৌশল তৈরি করছে, ‘মকরাক্ষ নিশাচর বুদ্ধি বড় সরু/ যুদ্ধ জিনতে রথে বেন্ধে গরু৷/ গোচর্ম্মেতে ঢাকে রথ করিয়া মন্ত্রণা/ সর্ব্ব অঙ্গে ঢাকা দিল গোচর্ম্মের শানা৷’ এর পাশে অবনীন্দ্রনাথ সেঁটে দিলেন সে কালের গোরক্ষাপ্রচারের বিজ্ঞাপন৷

আরও পড়ুন: ভাষার প্রাণ

তাঁর ‘নোয়ার কিস্তি’ পালায় এক নতুন পৃথিবীর কথা বলেছিল নোয়ানী, বলেছিল ‘মানুষগুলোর আলোতে বার হবার পথটা পরিষ্কার করে দাও৷’ সেখানে মনু বলছেন, ‘ধর্মের ঘুণ বড়ো ভয়ানক৷ চেনো না তাই ওকথা বলছ৷ গোবর মাটি কাঁচাপাতা, এমন কি জলে পর্যন্ত সে গিয়ে ধরে৷ কোনদিন দেখবে ঐ মানুষগুলো তোমার হাতের ন্যায়দণ্ড মুগুরে পর্যন্ত ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷’

মৃত্যুর প্রায় সাত দশক পরে ‘ভারতমাতা’র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের ভারতে মনুর কথাগুলো এমন ফলে যাবে কে জানত!

Abanindranath Tagore অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর Great Indians
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy