Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ধনী অনেক, দাতা কই?

শেক্সপিয়র লিখেছিলেন, করুণার প্রকৃতি আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির মতোই। তার স্পর্শে দাতা আর গ্রহীতা দু’জনেই ধন্য হয়। প্রায় সব ধর্মে দানের প্রশংসা করা হয়েছে।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৯ ০০:১১
Share: Save:

ধনী ব্যক্তির পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, কোটিপতি। ‘কোটি’-র চাইতে বড় অঙ্ক চলতি ভাষায় মেলে না। অথচ ২০১৮ সালে ভারতে ৮৩১ জন এমন ধনী ছিলেন, যাঁদের প্রত্যেকের সম্পদের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এঁদের গড় ধনের পরিমাণ ৫৯০০ কোটি টাকা। যাঁদের ঘরে রয়েছে এমন বিপুল সম্পদ, তাঁরা কতটা দান করছেন জনকল্যাণে?

ধনীদের দেশের কাজে দান করার দু’টি রাস্তা আছে। ব্যক্তিগত দান, কিংবা ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বা নিগমের সামাজিক দায়বদ্ধতা— সংস্থার লাভের দু’শতাংশ জনস্বার্থে খরচ। ব্যক্তিগত দান ব্যক্তির ইচ্ছাধীন, কোম্পানিদের দান ২০১৩ সাল থেকে আইনত বাধ্যতামূলক।

শেক্সপিয়র লিখেছিলেন, করুণার প্রকৃতি আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির মতোই। তার স্পর্শে দাতা আর গ্রহীতা দু’জনেই ধন্য হয়। প্রায় সব ধর্মে দানের প্রশংসা করা হয়েছে। এ দেশে দাতা কর্ণ, হরিশচন্দ্র, হর্ষবর্ধনের গল্প মুখে মুখে ফেরে। আজ কি এ দেশে ধনীরা উদারচিত্তে, সানন্দে দান করছেন? এর উত্তর, না। যে ৮৩১ জন ধনীর মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি, তাঁদের মধ্যে মাত্র উনচল্লিশ জন (৫ শতাংশ) দেশের কল্যাণে ১০ কোটি বা তার বেশি টাকা দান করেছেন। সর্বাধিক সম্পদশালী ন’জন (যাঁদের মোট সম্পদ ১১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি) পাঁচ বছরে মাত্র ছয় শতাংশ টাকা দেশের মানুষের জন্য দিয়েছেন। কেবল তা-ই নয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ধনীদের মোট দান ছিল বাষট্টি হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে আটচল্লিশ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন মাত্র এক জন। তাঁর নাম আজিম প্রেমজি। বাকিরা সবাই মিলে দিয়েছেন ১৪ হাজার কোটি।

আর নিগম বা কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে যে টাকা খরচ করতে হয়, তার পরিমাণ কেমন? তারা কী ধরনের কাজে দান করতে পারবে, তা আইনে স্পষ্ট করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলকে দান, বা মন্দির-মসজিদে দান তার মধ্যে পড়ে না। সর্বশেষ তথ্য, সামাজিক দায়ের জন্য কর্পোরেট ঝুলি থেকে ২০১৬-১৭ সালে বেরিয়েছে মাত্র চোদ্দো হাজার কোটি টাকা। তার আগের বছরগুলিতে ছবিটা কিছু আলাদা নয়। একটি হিসাবে, উনিশ হাজারেরও বেশি কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে মাত্র হাজার তিনেক আয়ের দু’শতাংশ খরচ করার আইনি নির্দেশ মেনেছে। হাজার পাঁচেক সংস্থা খরচ করেছে দু’শতাংশের কম, বাকি দশ হাজারেরও বেশি কোম্পানি কোনও হিসেবই দেয়নি।

কিন্তু শুধু কি ‘সুপার রিচ’ বা অতি-ধনীরাই দান করেন? ছোট সংস্থা বা তুলনায় স্বল্পবিত্ত মানুষ হয়তো বেশি টাকা দান করতে পারেন না, কিন্তু তাঁদের সকলের মোট দানের অঙ্ক কি খুব কম হবে? সে তথ্য এ দেশে পাওয়া খুব কঠিন। একটা পরোক্ষ উপায় আছে। দান করলে আয়কর আইনে ৮০জি ধারায় ছাড় পাওয়া যায়, সরকারের কাছে তার হিসেব থাকে। দেখা যাছে ২০১৬-১৭ সালে তিন কোটি ব্যক্তি চারশো কোটি টাকারও বেশি দান করেছেন, তার জন্য আয়করে ছাড় নিয়েছেন। অবশ্য আয়করদাতার সংখ্যা এ দেশে খুবই কম। ধরেই নেওয়া চলে, সর্বসাধারণের দানের একটি ক্ষুদ্র পরিমাণ এই চারশো কোটি টাকা।

তবু সব মিলিয়ে ছবিটা আশাব্যঞ্জক নয়। জাতীয় উৎপাদনের কতটা দান করে ব্যক্তি বা সংস্থা, তার ভিত্তিতে গোটা বিশ্বের দানের এক সূচকে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ১৩৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৮১-তে। চিন রয়েছে আরও অনেকটা পিছিয়ে—১৩৪-এ। অন্য এক পড়শি মায়ানমার আছে এক নম্বরে। শ্রীলঙ্কা আর ভুটানের স্থানও ভারতের অনেক ওপরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে। সে দেশে সাধারণ মানুষের ও কোম্পানিগুলির মোট দানের পরিমাণ জিডিপি-র দুই শতাংশ।

এক দিকে দানের ছবি করুণ, অন্য দিকে সম্পদ বণ্টনে ভয়াবহ অসাম্য। দেশের আটান্ন শতাংশ সম্পদের মালিক এক শতাংশ মানুষ, দশ শতাংশ ভারতীয়ের দখলে রয়েছে দেশের আশি শতাংশ সম্পদ। অসাম্যের পরিমাণ ১৯৯০ থেকে লাগাতার বেড়েছে। একটি রিপোর্ট বলছে, অসাম্যের নিরিখে সবার উপরে রাশিয়া, তার পরেই ভারত। হিসেবের ফেরে স্থান সামান্য বদলাতে পারে, খুব বেশি নয়।

সমাজে সাম্য আনার অন্য একটি উপায়, কর। আয়কর (১৭ শতাংশ) আর কোম্পানি কর (২১ শতাংশ) মিলিয়ে কেন্দ্রের ঘরে আসে বাজেটের আটত্রিশ শতাংশ। এই টাকা আসে অবস্থাপন্ন মানুষদের থেকে। বিক্রয় কর-সহ অন্যান্য কর থেকে আসে বাজেটের প্রায় ৩৯ শতাংশ, যা সব নাগরিকই কোনও না কোনও ভাবে দিয়ে থাকেন। জনকল্যাণে কেন্দ্রের বাজেটের ৩৫ শতাংশ খরচ হয়। প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্য। তার সঙ্গে অপশাসন, দুর্নীতি তো আছেই। বড় কোম্পানিগুলির উপর কর বাড়ালে বিনিয়োগ হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে।

এই অবস্থায় জনকল্যাণে দানের গুরুত্ব অসীম। পুণ্যের আশায় মন্দির-মসজিদে, আর লাভের আশায় রাজনৈতিক দলকে টাকা দেওয়ার বাইরে দান করার অভ্যাস কি এ দেশে গড়ে উঠবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Billionaires Welfare
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE